সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৩৫ অপরাহ্ন

যেভাবে জাকাতের হিসাব করবেন

Reporter Name
  • Update Time : রবিবার, ১ মে, ২০২২
  • ১০৫ Time View

ডেস্ক নিউজ : জাকাত ইসলামী শরিয়তের অন্যতম একটি স্তম্ভ ও ফরজ বিধান। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হলো সালাত ও জাকাত। জাকাতের অর্থ বিশুদ্ধ বা পবিত্রকরণ। জাকাত দিলে আপনার সম্পদ পরিশুদ্ধ হয়। লোভীদের কুদৃষ্টি ও আল্লাহর গজব থেকে নিরাপদ হয়। জাকাতের যথাযথ প্রয়োগে সামাজিক বন্ধন ও নিরাপত্তাবলয় সুদৃঢ় হয়।

মনে রাখতে হবে, আপনি যখন ১০০ টাকা আয় করেন, তখন এর পুরোটার মালিক আপনি হতে পারেন না। আপনার এই ১০০ টাকায় গরিবের আড়াই টাকা থাকে। এই আড়াই টাকা হকদারকে দিলে আপনার বাকি টাকা বিশুদ্ধ হয়। রাষ্ট্রের কর না দিলে যেমন আপনার উপার্জিত সাদা টাকা কালো হয়ে যায়, তেমনি জাকাত না দিলে আপনার সম্পদ অপবিত্র হয়ে যায়। কোরআন মাজিদে বহু স্থানে সালাত-জাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ সওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তোমরা সালাত আদায় করো এবং জাকাত প্রদান করো। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা করো আল্লাহ তা দেখছেন। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১১০)

প্রিয় পাঠক! আমরা আজ বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে জাকাত কে দেবেন, কোথায় দেবেন, কিভাবে দেবেন। সেই সংক্রান্ত কিছু মাসআলা নিয়ে আলোচনা করব।

জাকাত ফরজ হয় এমন সম্পদ :

সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা ও ব্যবসার পণ্য—এই চারটি জিনিসের ওপর জাকাত আসে। কিছু জন্তুর ওপরও জাকাত আসে। তবে সাধারণত ওই সব জন্তুর ওপর জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য প্রযোজ্য শর্তাবলি আমাদের দেশে পাওয়া যায় না।

মাসআলা : সোনা-রুপা যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, তা জাকাতযোগ্য সম্পদ হিসেবে ধর্তব্য হবে। চাই তা বিস্কুট আকারে থাকুক বা মুদ্রা হিসেবে থাকুক বা অলংকার হিসেবে থাকুক বা পাত্র হিসেবে থাকুক। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৩৯৪)

মাসআলা : সোনা-রুপা ব্যতীত অন্যান্য ধাতুর অলংকার যত মূল্যবানই হোক না কেন, ব্যবসার নিয়ত ব্যতীত তা জাকাতযোগ্য সম্পদ হিসেবে ধর্তব্য হবে না। (আহকামে জাকাত : পৃ. ১৯, ইমদাদুল ফাতাওয়া : ২/০৭)

মোট কথা এ ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো—সোনা-রুপা, নগদ টাকা ও ব্যবসার মাল ব্যতীত যত সম্পদ রয়েছে তা যত বেশি দামি হোক না কেন, তার ওপর জাকাত আসে না। আর সোনা-রুপা ব্যতীত যেকোনো সম্পদ যখন তা ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয় তখন জাকাতযোগ্য সম্পদ হিসেবে ধর্তব্য হবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/১৮০)

জাকাতের নিসাব বা কোন ব্যক্তি জাকাত দেবেন :

জাকাতের নিসাব নির্ধারণে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। এক. যার কাছে সাড়ে সাত তোলা পরিমাণ সোনা থাকে।    দুই.  যার কাছে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা থাকে। তিন. যার কাছে সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার যেকোনো একটির মূল্যের সমপরিমাণ টাকা-পয়সা বা ব্যবসার মাল থাকে।    চার. যার কাছে জাকাতযোগ্য চারটি (সোনা, রুপা, টাকা-পয়সা ও ব্যবসার মাল) সম্পদই থাকে, যার সমষ্টিগত মূল্য উপরোক্ত পরিমাণ সোনা বা রুপার যেকোনো একটির মূল্যের সমপরিমাণ হয়। পাঁচ. যার কাছে জাকাতযোগ্য যেকোনো তিনটি বা দুটি সম্পদ থাকে, যার সমষ্টিগত মূল্য উপরোক্ত পরিমাণ সোনা বা রুপার (সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা) যেকোনো একটির মূল্যের সমপরিমাণ হয়, তবে সে নেসাবের মালিক হিসেবে ধর্তব্য হবে এবং বছরান্তে তার ওপর জাকাত ফরজ হবে। (আল-ফিকহুল ইসলামী : ২/৬৬৯; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস ৭০৮১)

জাকাত কাকে দেবেন :

গরিব-ফকির লোককে জাকাত দিতে হবে। ধনীদের জাকাত দেওয়া যাবে না। ধনী দুই প্রকার। এক. যার জাকাতের নিসাব পরিমাণ মাল রয়ছে। এবং এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। দুই. যার ওপর জাকাত ওয়াজিব হয়নি বটে, তবে তার প্রয়োজন অতিরিক্ত এমন সম্পদ রয়েছে, যার মূল্য জাকাতের নেসাবের মূল্যের সমপরিমাণ। এমন লোকের ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়, তবে সদকায়ে ফিতর ও কোরবানি ওয়াজিব। উপরোক্ত দুই প্রকার ধনীকেই জাকাত দেওয়া জায়েজ নেই।

কোনো অমুসলিমকে  জাকাত দিলে তা আদায় হবে না। ঋণী ব্যক্তিকে জাকাত দেওয়া যায়। তবে শর্ত হলো, ওই ঋণী ব্যক্তির ঋণ আদায়ের পর যেন নিসাব পরিমাণ সম্পদ না থাকে।  উসুল ও ফুরু-কে জাকাত দেওয়া যায় না। উসুল বলতে বোঝায়, যাদের মাধ্যমে সে দুনিয়াতে এসেছে। যেমন মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, পরদাদা-পরদাদি—এভাবে যত ওপরে উঠবে। ফুরু বলতে বোঝায়, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, পোত-পুতনি—এভাবে যত নিচে নামবে। অর্থাৎ তার মাধ্যমে যারা দুনিয়াতে এসেছে। দুধ-মা, দুধ-সন্তান ও দুধ-পিতাকে জাকাত দেওয়া যায়। সৎ মা, সিপতা ও সৎসন্তানকে জাকাত দেওয়া জায়েজ আছে। তারা উসুল বা ফুরুর মধ্যে গণ্য হয় না। মুসাফির ভিনদেশে যখন নিরুপায় হয়ে পড়ে, বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে অক্ষম, তখন তাকে জাকাত দেওয়া যায়, যদিও সে বাড়িতে খুব ধনী হয়। জনকল্যাণমূলক কোনো কাজে জাকাতের অর্থ ব্যয় করলে জাকাত আদায় হবে না। যেমন—রাস্তা বা পুল নির্মাণ, কূপ স্থাপন ইত্যাদি। ভাই-বোন, চাচা-চাচি, মামা-মামি, খালা-খালু, ফুপা-ফুপু, শ্বশুর-শাশুড়ি, জামাই, ভাতিজা-ভাগ্নে যদি গরিব হয় তবে তাদের জাকাত দেওয়া যায়। (হিদায়া : ১/২০৬; ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/১৮৮-১৮৯, তাতারখানিয়া : ৩/২০৬, দুররুল মুখতার : ৩/২৯৪-২৯৫)

আধুনিক কয়েকটি বিষয় ও জাকাতের হুকুমস : 

শেয়ার মার্কেট : যারা শেয়ার ক্রয় করেন, তাঁরা মূলত দুটি উদ্দেশ্যে শেয়ার ক্রয় করে থাকেন। এক. বার্ষিক ডিভিডেন্ড (লভ্যাংশ) গ্রহণের উদ্দেশ্যে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে শেয়ার ক্রয় করেন। অর্থাৎ কম্পানির শীর্ষ পর্যায় থেকে যে লভ্যাংশ ঘোষণা হবে তা-ই তাদের উদ্দেশ্য। দুই. যাঁরা শেয়ারকে অন্যান্য পণ্যের মতো লাভের আশায় বেচা-কেনা করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য থাকে, আশানুরূপ দর পেলেই তা বিক্রি করে দেবেন। বার্ষিক লভ্যাংশ তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে না।

উপরোক্ত দুই শ্রেণির শেয়ারহোল্ডারের জাকাতের হুকুম ভিন্ন ভিন্ন। প্রথম শ্রেণির শেয়ার ব্যবসায়ীরা শেয়ারের বর্তমান বাজারদরের ওপর জাকাত আদায় করবেন। ফেস ভ্যালুর ওপর নয়। অর্থাৎ যেদিন তাঁর জাকাতের অর্থবছর পূর্ণ হবে, সেদিন ওই শেয়ারের মার্কেট ভ্যালু কত? তার ওপর জাকাত আদায় করবে।

আর দ্বিতীয় শ্রেণির শেয়ার ব্যবসায়ীরা প্রথমে ব্যালান্সশিট দেখে কম্পানীর স্থায়ী সম্পদ (ঋরীবফ অংংবঃং) ও জাকাতযোগ্য সম্পদের অনুপাত বের করবেন। কম্পানির স্থায়ী সম্পদ হলো বিল্ডিং, মেশিন, জমি, গাড়ি ইত্যাদি। অর্থাৎ যেগুলো বিক্রি করা হয় না। আর জাকাতযোগ্য সম্পদ হলো নগদ টাকা, ব্যবসায়ের সামগ্রী ও বিভিন্ন পর্যায়ের কাঁচামাল ইত্যাদি। অতঃপর কম্পানির মোট সম্পদের যত পার্সেন্ট জাকাতযোগ্য হয়, সে তার শেয়ারের বাজারদরের তত পার্সেন্টের জাকাত আদায় করবে। (ফিকহি মাকালাত : ১/১৫৫; জাদিদ ফিকহি মাসায়িল : ১/২১২; ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১৪/১৩৬) 

বন্ডের জাকাত : বন্ড মূলত ঋণের সার্টিফিকেট। বন্ডসহ যাবতীয় অর্থনৈতিক সনদের জাকাত আদায় করা ওয়াজিব। কেননা এগুলো নগদ অর্থতুল্য। (আহকামে জাকাত : ১৬)

প্রভিডেন্ট ফান্ডের জাকাত : সরকারি বা বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন থেকে জিপি বা সিপি ফান্ডের জন্য বাধ্যতামূলক যে অংশ কর্তন করা হয়, তা উত্তোলনের আগে চাকরিজীবীর মালিকানায় আসে না। তাই ফান্ডে থাকাকালীন ওই টাকার ওপর জাকাত আসবে না। আর যেসব চাকরিজীবী (সরকারি বা বেসরকারি) বাধ্যতামূলকের পাশাপাশি ঐচ্ছিকভাবে টাকা রাখেন বা পুরোটাই ঐচ্ছিকভাবে রাখেন বা সে নিজ উদ্যোগে ওই ফান্ডের টাকা অন্য কোনো ইনসুরেন্স কম্পানিতে স্থানান্তর করিয়ে নেন, তাঁদের ওই ফান্ডের টাকা জাকাতযোগ্য সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। কজেই তিনি নেসাবের মালিক হলে ওই টাকারও জাকাত আদায় করবেন। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/২৬০; ফাতাওয়ায়ে শামি : ২/৩০৬)

ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত টাকার জাকাত : ব্যাংকের ব্যক্তিমালিকানাধীন সব ধরনের অ্যাকাউন্টের গচ্ছিত টাকা জাকাতযোগ্য। চাই কারেন্ট অ্যাকাউন্ট হোক বা সেভিংস অ্যাকাউন্ট হোক বা ফিক্সড ডিপোজিট হোক অথবা দীর্ঘমেয়াদি ডিপোজিট হোক বা স্যালারি অ্যাকাউন্ট হোক, সব অ্যাকাউন্টের জাকাত আদায় করতে হবে, যদি সে নেসাবের মালিক হয়। (ফাতাওয়া আলমগিরি : ১/২৭০; ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ৩/৫৭)

ইম্পোর্টকৃত পণ্যের জাকাত : ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্য ইম্পোর্ট করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে যেসব পণ্য তাঁদের মালিকানায় চলে এসেছে, তার বাজারদরের ওপর জাকাত আদায় করবেন, যদিও ওই পণ্য রাস্তায় থাকার কারণে তাঁর কবজায় না আসে। আর যদি পণ্য তাঁর মালিকানায় না আসে; বরং টাকা ইনভেস্ট করেছে; কিন্তু এখনো পণ্যের ক্রয়চুক্তি হয়নি, তবে শুধু ইনভেস্টকৃত টাকার জাকাত আদায় করবে। (জাদিদ ফিকহি মাসায়িল)

এখানে শুধু কিছু মাসআলার মৌলিক দিক তুলে ধরা হয়েছে। বিশদ জানতে কোনো অভিজ্ঞ আলেমের সঙ্গে কথা বলে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে জাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধান পালনে আন্তরিক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অনুবাদক ও মুহাদ্দিস, saifpas352@gmail.com

 

 

কিউএনবি/আয়শা/১ মে, ২০২২/১৮ বৈশাখ, ১৪২৯/দুপুর ১:০৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit