বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪৪ অপরাহ্ন

বদরুদ্দীন উমরের জীবন ও কাজ নিবেদিত প্রবন্ধাবলি: একটি বিশ্লেষণ

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২
  • ৯৮ Time View

 

সাহিত্য ডেস্ক : বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশে এক বহুল পরিচিত নাম। নব্বই বছর অতিক্রান্ত এক ব্যক্তি যিনি আজও সক্রিয় জীবনযাপন করছেন। এ দীর্ঘজীবনের অধিকাংশ সময় তিনি মার্কসীয় ধারার রাজনীতির সংগঠকের কাজ করার সঙ্গে লেখনীকে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের সপক্ষে ব্যবহার করেছেন। এ দেশে তিনি একমাত্র রাজনীতিক, যিনি একসঙ্গে সমাজ কাঠামো পরির্বতনের লক্ষ্যে তত্ত্বচর্চা করার সঙ্গে তত্ত্বনির্মাণও করেছেন। সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি শ্রেণি বিভাজন ও দ্বন্দ্বের ওপর নির্মিত এবং বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে তার ভাষা অকপট ও তীক্ষ্ণ। 

২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১৭টি। শিক্ষকতার জীবন অনেক আগেই ত্যাগ করে তিনি রাজনীতির জগতে এলেও লেখার ক্ষেত্রে তিনি গবেষকের মতো পরিশ্রম করে তার বক্তব্য তৈরি করেছেন। বদরুদ্দীন উমর প্রথম জীবনে শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, যা তাকে বিত্তবান করতে ও সমাজের পাদপ্রদীপের আলোকে নিয়ে আসতে পারত। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভকারী এবং চট্টগ্রাম কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত একজন ব্যক্তির পক্ষে উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে ওঠা কঠিন কিছু ছিল না। অক্সফোর্ডে পড়াকালীন তিনি মার্কসবাদের দিকে ঝুঁকে গিয়েছিলেন।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার নিশ্চিত পেশার জীবন ছেড়ে স্বেচ্ছায় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং সে রাজনীতি প্রথাগত রাজনীতি নয়, কমিউনিস্টদের ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর রাজনীতি। কমিউনিস্ট সংগঠনের নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে তিনি এখনও কমিউনিস্ট হিসাবেই রাজনীতি করছেন। অনেক তথাকথিক কমিউনিস্টের মতো ভোল পাল্টে সাবেক কমিউনিস্ট নেতা বা শাসক দলের সহযোগী হিসাবে পরিচিত হননি। তিনি তার মতাদর্শের ব্যাপারে স্পষ্ট মত ধারণ করেন এবং তা প্রকাশ করতে তার কোনো কুণ্ঠা নেই। তার স্পষ্ট মতের কারণে অনেকে যদিও তার সঙ্গ ত্যাগ করেছে, তার পরও তিনি এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে উচ্চারিত প্রথম সারির এক নাম।

তিনি রাজনীতিতে ঢুকে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) সদস্য পদ নিলেও ১৯৭১ সালে পার্টির গৃহীত রাজনৈতিক লাইনের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেন। স্বাধীনতার পর তার কয়েকজন সহযোগী নিয়ে নতুন পার্টি গঠন করেন। তা ছাড়া কৃষক ফেডারেশন, বাংলাদেশ লেখক শিবির, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল এবং ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় কমিটি গঠন তার সাংগঠনিক কাজের অন্তর্ভুক্ত। 

তাকে অনেকে সমালোচনা করে যে তিনি কোনো সংগঠন ও কর্মী ধরে রাখতে পারেননি এবং তিনি বিশুদ্ধবাদী হওয়ার কারণে সফল হতে পারছেন না। তথাপিও জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের কোনো কমিউনিস্ট নেতার নাম উচ্চারিত হলে সেটা অবশ্যই উমরের নাম। তিনি শুধু সাংগঠনিক কাজ করেন তা তো নয়। তিনি তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশ ও পৃথিবীতে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির যেভাবে বিশ্লেষণ করেন, বাংলাদেশের আর কোনো কমিউনিস্ট তা করতে পারেন বলে প্রমাণ নেই।

তরুণ বয়সে তিনি সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯) শিরোনামে তিনটি বই লিখেছিলেন যা পাকিস্তানি যুগের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যবান রাজনৈতিক রচনা হিসাবে আলোড়ন তুলেছিল। আজ অবধি ১২১টি শিরোনামে তার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এসবের কোনো কোনোটি কলকাতায়ও ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশে একই বই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশক প্রকাশ করেছেন। সবচেয়ে শ্রমসাধ্য যে কাজটি করে তিনি বাঙালি জাতিকে ঋণী করেছেন, সেটি তিন  খণ্ডের পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি। 

বদরুদ্দীন উমরের জন্মস্থান ভারতের পশ্চিমবাংলায়। ১৯৪৮ সাল থেকে যে দেশকে তিনি তার মাতৃভূমি বানিয়েছেন, সেখানে তার কাজের তেমন কদর করা হয় না। বরং তাকে বিতর্কিত করে রাখার এক প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। তার স্পষ্ট বক্তব্য তাকে রাষ্ট্রের শাসক ও আমলাতন্ত্রের কাছে শত্রুতে পরিণত করেছে যেমন তার সমজাতীয মতাদর্শের ব্যক্তিদের কাছে অপছন্দনীয় করে রেখেছে। তবে উমরকে উপেক্ষা করা হলেও তিনি আদৌ হতোদ্যম না হয়ে রাজনীতি ও লেখনীতে সক্রিয় থেকেছেন। তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির ধার ধারেনি। বরং কোনো কোনো সময় তাকে পুরস্কারে ভূষিত করতে চাইলেও তা তিনি প্রত্যাখ্যান করার দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। 

বদরুদ্দীন উমরের ৯০ বছর জীবনের পূর্তিতে তার গুণগ্রাহী কয়েকজন সম্প্রতি ‘বদরুদ্দীন উমরের জীবন ও কাজ নিবেদিত প্রবন্ধাবলি‘ শিরোনামে প্রায় পাঁচশ‘ পৃষ্ঠার এক সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। সম্পাদনা পরিষদে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সিআর আবরার, গোলাম মুস্তাফা, চৌধুরী মুফাদ আহমদ এবং ওমর তারেক চৌধুরী। এর প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। অত্যন্ত সুমুদ্রিত গ্রন্থটির মূল্য ৬০০ টাকা। গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেখকদের লেখা, উমরের একটি সাক্ষাৎকার, তার রচিত গ্রন্থের তালিকা এবং জীবনপঞ্জি। কয়েক ভাগে গ্রন্থটি সাজানো হয়েছে। যেমন- রচনা প্রসঙ্গ, নিবেদিত প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণ, প্রতিক্রিয়া, জীবন ও কর্ম, সাক্ষাতকার এবং বিবিধ।

প্রথম ফ্ল্যাপে সম্পাদকদের বক্তব্যের কয়েকটি লাইনে পাঠকের কাছে গ্রন্থটি সম্পর্কে শুরুতেই একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে। ‘বদরুদ্দীন উমর বহু ক্ষেত্রে পথিকৃত এবং প্রায় ছয় দশক ধরে মূলধারার বিপরীত ধারাতে চলা বিরামহীন পদাতিক। সে অর্থে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি প্রকৃত পক্ষে জনপ্রিয়তার হাওয়ায় পাল না-খাটানো অনন্য ও স্পষ্টভাষী ভিন্নমতাবলম্বীও। গণতন্ত্রের শক্তি যদি হয় গণস্বার্থে ন্যায়সঙ্গত ভিন্নমত পোষণ, উমর তার এক অতুলনীয় বিরল দৃষ্টান্ত; যার অমোচনীয় প্রমাণ ছড়িয়ে আছে তার শতাধিক গ্রন্থ আর বহুমুখী রাজনৈতিক সক্রিয়তার মাঝে।‘

 

 

কিউএনবি/আয়শা/১৫ই মার্চ, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ/বিকাল ৩:৩২

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

December 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৬
IT & Technical Supported By:BiswaJit