রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২২ অপরাহ্ন

মৃত্যুর আগে ‘রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি’ চান মুক্তিযোদ্ধা নুরন নবী

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০২২
  • ১৫৭ Time View
জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট প্রতিনিধি :দীর্ঘ নয়মাস জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেও বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরন নবীর ভাগ্যে ৫০ বছরেও জুটেনি রাষ্ট্রীয় সম্মান।বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরন নবী লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভাদাই ইউনিয়নের কিসামত ভেটেশ্বর গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের ছেলে। বর্তমানে দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে রংপুর শহরের নিউসেন পাড়ায় তার বসবাস। তিনি ভারতীয় তালিকার ০৫ নং খন্ডের ১৭৬নং বইয়ের ৪৩৩৭৬ নম্বর বীরমুক্তিযোদ্ধা।

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে লালমনিরহাট কলেজের (বর্তমান সরকারী) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নুরন নবী কিসামত ভেটেশ্বর গ্রামের কয়েকজন বন্ধুসহ বাংলাদেশ বেতারে মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনছিলেন। এ সময় কয়েকজন রাজাকার এসে তাদের উপর হামলা চালালে একজন বন্ধু শহীদ হন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অন্য সকল বন্ধু মিলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার শপথ নেন নুরন নবী। ওই দিনই বন্ধুদের নিয়ে ভারতের মুজিব ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখানে এক মাস অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষন নিয়ে এসএলআর অস্ত্রসহ দেশে ফেরেন।

দিনাজপুরে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন  টগবগে যুবক নুরন নবী। সেখানকার স্মৃতিচারনে বলেন, সহযোদ্ধারাসহ বাঙ্কারে অবস্থান কালে  রাজাকারসহ পাকবাহিনী তাদের বাঙ্কার ঘিরে রাখে। পাকবাহিনীর ৬সিলিন্ডার মটারের জবাব দুই সিলিন্ডার মটার দিতে কয়েকজন সহযোদ্ধা শহীদ হন। একজন গুলিবিদ্ধ হন। পাকবাহিনীর গুলির জবাব দিতে দিতে আহত সহযোদ্ধাকে পুনরায় বাঙ্কারে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন নুরন নবী। একপর্যয়ে পাকবাহিনী পিছু হটলে আহত সহযোদ্ধা আমিরকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এরপর ক্যাপ্টেন দেলওয়ার হোসেন ও মেজর নাজেশের নেতৃত্বে ৬নং সেক্টরের অধীনে লালমনিরহাটের বড়বাড়ী, মোগলহাট এলাকায় যুদ্ধে অংশ নেন নুরন নবী। সেখানেও সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকবাহিনীকে লালমনিরহাট থেকে বিতারিত করেন। পাকবাহিনী তিস্তা রেল সেতু উড়িয়ে দিয়ে রংপুরের হারাগাছ এলাকায় অবস্থান নিলে সহযোদ্ধারাসহ নুরন নবী লালমনিরহাটের খুনিয়াগাছ এলাকায় তিস্তা নদীর বাম তীরে অবস্থান নেন। পাকবাহিনী তিস্তা নদী ডান তীরে আক্রমন চালালে মুক্তিবাহিনী বাম তীর থেকে আক্রমন করে। দির্ঘক্ষন যুদ্ধ চলার পর হারাগাছ থেকেও শত্রুদের বিতারিত করেন নুরন নবী ও তার সহযোদ্ধারা।অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি কক্ষে অস্ত্র জমা দিয়ে মাত্র ৩০০ টাকা সম্মানী ভাতা আর এমজি ওসমানির স্বাক্ষারীত সনদ হাতে বাড়ি ফিরেন বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরন নবী। বাড়ি ফিরে দেখেন তাদের থাকার ঘর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে পাকবাহিনী আর তাদের দোসররা। নিরুপায় নুরন নবী পোড়া টিনের ছায়লা ঘরে জীবন শুরু করেন। ১৯৭২ সালের এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উন্নীর্ন হন।

বিয়ে করেন রংপুরের সেনপাড়া এলাকায়। নিজের থাকার ঘর নেই তাই শ্বশুরালায়ে বসবাস শুরু করেন তিনি। নিজ বাড়ি থেকে শ্বশুলায়ে স্থানান্তর করতে নিজের শিক্ষা সনদসহ এমজি ওসমানির স্বাক্ষরীত মুক্তিযোদ্ধার সনদটিও হারিয়ে ফেলেন। সনদ হারিয়ে যাওয়ায় চাকুরী করার ইচ্ছে পুরন হয়নি তার। শুরু করেন মুদি ব্যবসা।পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানের ঘোষনা দিলে ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা সংগ্রহ করে তার নাম দেখে নিজের নামে গেজেট করতে আবেদন করেন নুরন নবী। সেটা কয়েক দফায় তদন্ত করে সত্যতা পেয়ে তার আবেদন ঊর্দ্ধগামি করেন স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলেও অদৃশ্য কারনে সুফল মিলেনি।

গত ২০১৮ সালেও ৪জন সহযোদ্ধার স্বীকৃতি স্বরুপ জবানবন্দির এফিডেভিটসহ গেজেটের জন্য আবেদন করেন নুরন নবী। যার প্রেক্ষিতে একই সালের ১জানুয়ারী ৩৯৪১ স্মারকের চিঠিতে তদন্তের নির্দেশ দেন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আরিফুল হক। যার তদন্ত প্রতিবেদন গেজেটের সুপারীশসহ ২০১৯ সালের ৩ডিসেম্বর পাঠান তৎকালিন আদিতমারীর ইউএনও আসাদুজ্জামান। এরই মাঝে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার জন্যও আবেদন করেন অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা নুরন নবী।জীবনের শেষ বয়সে এসে রাষ্ট্রীয় সম্মানের স্বীকৃতি পেতে অফিস পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত বয়সের ভাড়ে নাজুক নুরন নবী। সকল তদন্ত প্রতিবেদনে তাকে বীরমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেট ভুক্ত করার সুপারীশ করা হলেও মিলছে না কাংখিত সেই গেজেট আর সম্মান।

যুদ্ধকালিন নুরন নবীর কিসামত ভেটেশ্বর গ্রাম আদিতমারী মৌজা ছিল কালীগঞ্জ থানার অধিনে আর লালমনিরহাট ছিল রংপুর জেলার অধিনে। পরবর্তিতে বিভাজন হওয়ায় কপাল পুড়ছে মুক্তিযুদ্ধে সর্বচ্চ ত্যাগী নুরন নবীর। ভারতীয় তালিকায় গ্রাম কিসামত ভেটেশ্বর থানা কালীগঞ্জ জেলা রংপুর। তা বর্তমানে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী থানাধিন কিসামত ভেটেশ্বর গ্রাম। এটাই অস্পষ্টতার অজুহাতে আটকে যায় তার সম্মানের ফাইল। পরবর্তিতে গত ২০২০ সালের ১৬ জুলাই  উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বিতরন কমিটি মিটিংয়ে রেজুলেশনসহ নুরন নবীর ঠিকানা পরিস্কার করে গেজেটের সুপারীশ করেন তৎকালিন আদিতমারীর ইউএনও মনসুর উদ্দিন।

৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেও ৭/৮ বছর অফিস পাড়ায় দৌড়েও জীবনের শেষ চাওয়া পুরনে ব্যর্থ হচ্ছেন বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরন নবী। মৃত্যুর পুর্বে হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আর সম্মান পেতে চান তিনি।বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরন নবী বলেন, শরীরে রক্ত ছিল তাই ভিনদেশী শত্রুদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছি। এখন শরীরে আর সেই তেজস্বীয় রক্ত নেই। হাটতে পারি না। তবুও মৃত্যুর পুর্বে রাষ্ট্রীয় সম্মানের জন্য অফিস পাড়ায় লাঠিভর করে ঘুরছি। মৃত্যু পুর্ব মুহুর্ত হলেও সম্মান পেতে চাই। নয়তো মরেও শান্তি পাবো না।নুরন নবীর সহযোদ্ধা বীরমুক্তিযোদ্ধা শাহাব উদ্দিন, আব্দুর রশিদ, আজিজার রহমান বলেন, নুরন নবী আমাদের সাথে ৬নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন। প্রাপ্য সম্মান দিতে তার গেজেটের জন্য আমরা বিভিন্ন দফতরে সরাসরি কথাও বলেছি। বিভিন্ন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে প্রমানও দিয়েছি। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। দ্রুত তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে জোর দাবি জানান নুরন নবীর সহযোদ্ধরা।

কিউএনবি/অনিমা/২৫শে জানুয়ারি, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ /সন্ধ্যা ৬:০৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit