শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম

কাশ্মীর নিয়ে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব কি ভারতকে বিব্রত করেছে?

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫
  • ৪৬ Time View

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ বিতর্কে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা অনেক দশক ধরেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটা নিষিদ্ধ বিষয় বা ট্যাবু হয়ে থেকেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন ভারতের একটা অতি স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে তিনি তো অভিনব পথে কূটনীতির জন্য পরিচিতই।

শনিবার তিনি সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা করে দেন যে, চার দিন ধরে সীমান্ত সংঘর্ষ চালানোর পরে ভারত আর পাকিস্তান মার্কিন মধ্যস্থতায় ‘সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি’তে রাজী হয়েছে। পরে, আরেকটি পোস্টে তিনি লেখেন, কাশ্মীর নিয়ে হাজার পরে হলেও কোনও সমাধানে পৌঁছনো যায় কী না তা দেখতে আমি আপনাদের দুই পক্ষের সঙ্গেই একযোগে কাজ করব।

পুরোপুরি যুদ্ধের আগেই ট্রাম্পের প্রস্তাব

কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কটা সেই ১৯৪৭ এ শুরু, যখন ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত স্বাধীনতা পায় আর দেশভাগ হয়ে পাকিস্তান তৈরি হয়।

দুই প্রতিবেশী দেশই পুরো কাশ্মীরের দখল চায়, যদিও তারা শাসন করে কাশ্মীরের দুই অংশে।

কয়েক দশক ধরে একাধিকবার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেও বিতর্কের সমাধান করা যায় নি।

ভারত দাবি করে কাশ্মীর সেদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ নিয়ে তারা কোনও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দর কষাকষিতে যেতে অস্বীকার করে এসেছে।

ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপরে হামলা চালিয়ে যখন ২৬ জনকে হত্যা করা হয়, তারপরেই ভারতের কথায়, ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী পরিকাঠামোর ওপরে’ আকাশপথে হামলা চালানোর পরেই দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ সংঘাতটা বাঁধে।

পেহেলগামের ঘটনার জন্য ভারত পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করে, যেটা আবার পাকিস্তান অস্বীকার করে।

দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে যখন সংঘর্ষ চলছিল, যখন থেকে পুরোপুরি যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার হুমকিও ঘনিয়ে উঠছিল, সেইরকম আবহাওয়াতেই ট্রাম্প মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন।

দুই পক্ষই যুদ্ধ বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন ব্যবহার করছিল এবং একে অপরের সীমান্ত ঘেঁষা সামরিক স্থাপনাগুলো আক্রমণ করছিল।

মার্কিন মধ্যস্থতাকারীদের হস্তক্ষেপ এবং পর্দার আড়ালে কূটনৈতিক আলোচনা দিয়ে যখন বড় সংঘাত এড়ানো গেল, তখনই ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিল্লিকে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে।

ভারতের সাবেক বিদেশ সচিব শ্যাম সরন বিবিসিকে বলছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই এই প্রস্তাবটিকে ভারত স্বাগত জানাবে না। বহু বছর ধরে আমাদের ঘোষিত অবস্থানের বিপরীত এই প্রস্তাবটি।

মধ্যস্থতার প্রস্তাবে বিস্মিত ভারতীয়রা

অন্যদিকে ইসলামাবাদ ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া এবং বৃহত্তর অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার ওপরে দীর্ঘ সময় ধরে যে বিষয়টি গুরুতর প্রভাব ফেলছে, সেই জম্মু-কাশ্মীরের বিতর্ক সমাধানে সহায়তা করার যে ইচ্ছা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রকাশ করেছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই।

জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ২০১৯ সাল থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর কাশ্মীর নিয়ে দিল্লির অবস্থান আরও কঠোর হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য অনেক ভারতীয়ই বিরক্ত। কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কের ‘আন্তর্জাতিকীকরণের’ প্রচেষ্টা হিসাবে দেখছেন তারা।

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে এবং ‘ওয়াশিংটন ডিসি থেকে যুদ্ধবিরতির প্রথম ঘোষণা’ করার ব্যাপারে একটি সর্বদলীয় বৈঠকও ডাকার কথা বলছে তারা।

কংগ্রেসের মুখপাত্র জয়রাম রমেশের প্রশ্ন, আমরা কি তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার পথ খুলে দিয়েছি? ভারতের জাতীয় কংগ্রেস জানতে চায় যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনা আবারও চালু হচ্ছে কী না।

যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এক বিবৃতিতে আরও বলেছেন, নিরপেক্ষ কোনও জায়গায় নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা শুরু করতে দুটি দেশই রাজি হয়েছে। ভারতীয়রা এই মন্তব্য দেখে বিস্মিত হয়েছেন।

ট্রাম্পের প্রস্তাবে সাড়া দেননি মোদি

প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে সীমান্ত পার থেকে তাদের ভাষায় ‘সন্ত্রাস’ ছড়ানোর অভিযোগ তুলে ইসলামাবাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অস্বীকার করে দিল্লি।

ঐতিহাসিকভাবে, ভারত যে কোনও তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার বিরোধিতা করে এসেছে। এর পেছনে দুই দেশের মধ্যে ১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির শর্ত দেখিয়ে থাকে ভারত।

দুটি দেশের শীর্ষ নেতাদের সই করা সিমলা চুক্তি অনুসারে, তারা ‘দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের মত-পার্থক্য নিষ্পত্তি করতে সংকল্পবদ্ধ’।

ভারতীয় কর্মকর্তারা আরও যুক্তি দেখান যে, পাকিস্তানের অসামরিক সরকারের সঙ্গে কোনও বোঝাপড়ায় পৌঁছানোর পরও দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনী সেইসব সমঝোতাগুলো নস্যাৎ করে দিয়ে সামরিক অভিযান শুরু করে।

এর উদাহরণ হিসাবে ভারতীয় কর্মকর্তারা ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের প্রসঙ্গ তোলেন। সেই সময়ে পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গিদের একটি দল ভারত শাসিত কাশ্মীরের কিছু কৌশলগত-ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল করলে দুই দেশের মধ্যে এক সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল।

কার্গিল যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগেই ভারত ও পাকিস্তানের তৎকালীন দুই প্রধানমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা এবং একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে সম্মত হয়েছিলেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাবে আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়া দেয়নি।

তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ভারত বরাবরই সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ও আপসহীন অবস্থান বজায় রেখেছে। এই অবস্থান অব্যাহত থাকবে।

এই মন্তব্য থেকে এরকম একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ভারত খুব তাড়াতাড়ি হয়তো সরাসরি দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করবে না।

পাকিস্তানের মতামতটা ভিন্ন

ইসলামাবাদের সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ইমতিয়াজ গুল বিবিসিকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা নেই বলেই পাকিস্তান সবসময় কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা চেয়ে এসেছে।

এখন একটি পরাশক্তি নিজে থেকেই উদ্যোগ নিয়েছে। পাকিস্তান এটাকে নৈতিক জয় হিসেবেই দেখবে। 

সৈয়দ মুহাম্মদ আলীর মতো পাকিস্তানের কৌশলগত বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিচ্ছেন যে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চালাতে ভারত ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করে এসেছে বলেই ভবিষ্যতে সংঘাত এড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কাশ্মীর অন্যতম জটিল ইস্যু। সম্প্রতি যত দ্রুত উত্তেজনা বেড়ে গেল, তা থেকেই প্রমাণিত হয় যে সামরিক শক্তি ব্যবহার করার হুমকি কত তাড়াতাড়ি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে।  

সাবধানে পা ফেলতে হবে ভারতকে

ভারতকে বিশ্বে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে ভারতকে সমর্থন করছে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরে উদীয়মান হওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী, তার অন্যতম ইঙ্গিত দেখা যায় মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের দৃঢ়-প্রত্যয়ী কূটনীতি।

কিন্তু ট্রাম্প যেভাবে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে এসেছেন, তা ঠেকাতে ভারতকে ভারসাম্য রক্ষার কঠিন কাজটা করতে হবে।

ক্রমেই আগ্রাসী হয়ে ওঠা চীনের বিরুদ্ধে একটি রক্ষাগরীয় অঞ্চলে চীনা সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে গঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের সঙ্গেই কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ গ্রুপ বা কোয়াডের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ভারত।

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ওয়াশিংটন আধুনিক পরিবহন বিমান, হেলিকপ্টার ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে ভারতের কাছে। ভারত তার ১৪ লক্ষ সদস্যবিশিষ্ট সামরিক বাহিনীকে আধুনিকীকরণ করতে চায়, কিন্তু তারা আবার রাশিয়ার অস্ত্রশস্ত্রের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

পূর্ববর্তী মার্কিন প্রশাসনগুলো কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের সংবেদনশীলতা সম্পর্কে সচেতন ছিল এবং মোটের ওপরে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থেকেছে।

কিন্তু ট্রাম্প আসার পরে সেই অবস্থান এখনও বজায় আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, ২০২৪ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রায় ১৩ শো কোটি ডলারে পৌঁছিয়েছে। বাড়তি শুল্ক এড়াতে  মোদির সরকার এখন ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে।

দিল্লিকে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনীহা থাকবেই। তবে এটাও ভারতকে দেখতে হবে যে মার্কিন মধ্যস্থতায় যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে, যেটিকে তারা ‘বোঝাপড়া’ বলছে, সেটা শুধুমাত্র সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে কী না।

অন্যদিকে ভারত আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনুকূল বাণিজ্য সম্পর্ক রাখতেও আগ্রহী। আলোচনার প্রেক্ষিত বিস্তৃত করে অন্যান্য বিতর্কিত দ্বিপাক্ষিক ইস্যু, যেমন বর্তমানে স্থগিত করে দেওয়া সিন্ধু জল বণ্টন চুক্তি বা কাশ্মীরের মতো অন্যান্য বিতর্কিত ইস্যুও আলোচনার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করলে দেশের ভেতরে যে তাকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হবে, তা মোদি ভাল করেই জানেন। 

 

 

কিউএনবি/আয়শা/১৩ মে ২০২৫, /রাত ৯:০৪

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit