ডেস্ক নিউজ : বীরাঙ্গনা সবজান বিবি। বয়স ৮০ ছুই ছুই। নেই নিজের কোনো বাড়িঘর। ভালো করে চলাফেরা করতেও কষ্ট হয়। আর অসুস্থতাতো লেগেই রয়েছে। অন্য-বস্ত্রের সঞ্চার হয় মানুষের দানে। অথচ এই সবজান বিবিই বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশ নামটা ভাঙলে খোঁজে পেতে হবে সবজান বিবিকে।
জীবনভর সংগ্রাম করে কোন রকমে বেঁচে আছেন তিনি। একাত্তরে হারিয়েছেন নিজের সম্ভ্রম আর স্বাধীন বাংলার ৫৩ বছর কঠিন সংগ্রাম। তবুও তাঁর আত্মতৃপ্তি স্বাধীন বাংলায় তিনি নিঃশ্বাস নিচ্ছেন।
সবজান বিবি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত ভাগ্যবিড়ম্বিত একজন বীরাঙ্গনা।
সবজান বিবি জানান, ১৯৭১ সালে তিনি ২৭-২৮ বছরের একজন যুবতি ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি সিন্দুরখানের ইসলামপুরে তার নানা বাড়িতে থাকতেন। ১৯৭১ সালে সিন্দুরখানে পাকবাহিনী আস্তানা গড়ায় তাঁর নানার বাড়ির সবাই অন্যত্র চলে যান। তিনি তার নানাকে খুবই পছন্দ করতেন। নানাও তাকে খুব আদর করতেন। বাড়ির সবাই অন্যত্র চলে যেতে চাইলে নানা বাড়ি ছাড়তে চাননি। কিন্তু নানা একা কিভাবে বাড়িতে থাকবেন তাঁকে দেখাশোনার জন্য তিনিও থেকে যান।
জানান, মনের মধ্যে কিছু ভয় নিয়ে নানার সেবাযত্ন করে যাচ্ছিলেন সবজান। কিন্তু কাল হয়ে দাঁড়ায় রাজাকার চক্র। সবজান বিবি তখন দেখতে খবুই সুন্দরী ছিলেন। রাজাকাররা পুরস্কার পাওয়ার জন্য ক্যাম্পে খবর দেয় সবজানের। এই খবর পেয়ে নারীলোভী পাকসেনারা তাদের বাড়িতে আক্রমণ করে।
আনুমানিক জুলাই/আগস্ট মাসের এক বিকালে স্থানীয় রাজকাররা কয়েকজন পাকসেনা নিয়ে উপজেলার সিন্দুরখানের ইসলামপুর গ্রামে সবর উল্লাহর বাড়িতে প্রবেশ করে। তখন সবর উল্লাহ বারান্দায় বসেছিলেন। বারান্দায় প্রবেশ করে সবর উল্লাহকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে পাকসেনারা। এ সময় রাজাকাররা দুজন সেনাসহয ঘরে প্রবেশ করে সবজানকে দেখিয়ে দেয়। একজন সৈন্য সবজানের দিকে অস্ত্র তাক করে রাখে। তখন রাজাকাররা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। এ সময় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে দুই পাকসেনার লালসার শিকার হন সবজান। পরের দিন আবার এসে অনুরূপ নির্যাতন করে।
এরপর তাঁকে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চায় পাকসেনারা। এ সময় সবজানের এক মামা ও নানা তাদের হাতে পায়ে ধরে ক্যাম্পে নিতে দেননি। এর দুই তিনদিন পর তিনি সেখান থেকে সরে জিলাদপুর বোনের বাড়িতে চলে আসেন।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। অনেক পরে সিলেটের মো: আছাদ মিয়ার সাথে সবজানের বিয়ে দেন আত্মীয় স্বজনরা। এর কিছুদিন পর ঘটনা জানাজানি হলে সবজান বিবির স্বামী তাঁকে ফেলে পালিয়ে যান। এরপর থেকে তিনি কখনও বোনের বাড়িতে কখনও অন্য মানুষের বাড়িতে কাজ করে জীবনানিপাত করে আসছেন।
বর্তমানে সরকার কর্তৃক বীরাঙ্গনাদের গেজেট ভুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে জেনে তিনি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করার জন্য আবেদন করেন। সবজান জানান, তার বাবা ছিলেন গরীব মানুষ। তিনি থাকতেন নানার বাড়িতে। নিজের কোন বাড়িঘর নেই। এখন তাঁর আর কাজ করারও কোন শক্তি নেই। এমতাবস্থায় ঢাকার নারীপক্ষ তাঁকে প্রতিমাসে ওষুধপত্র বাবৎ কিছু আর্থিক সহায়তা করে আসছে। নারী পক্ষের এই সহায়তার জন্য তিনি ওষুধ খেতে পারছেন।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন ছমরু জানান, সবজান বিবির জীবনটাই অতিবাহিত হচ্ছে কষ্ট করে করে। তিনি যুদ্ধ থেকে এসে সবজান বিবির এই ঘটনা শুনেছেন। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে সবজান বিবির আবেদন করতেও সাহায্য করেছেন।
তিনি বলেন, শেষ বয়সেও যদি বীরাঙ্গনা সবজানবিবিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেট ভুক্ত করা হয় তাহলে আর যে কয়দিন বেঁচে থাকবেন কিছুটা হলেও সুখের দেখা পাবেন এই বীরাঙ্গনা।
কিউএনবি/অনিমা/১৬ জুলাই ২০২৪,/সকাল ১১:৫১