লাইফ ষ্টাইল ডেস্ক : রোজায় আমাদের সুস্থ থাকতে সুষম খাদ্য খাবার প্রয়োজন। একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য যেই পরিমাণ খাবার প্রয়োজন হয় তাকে ব্যালেন্স ডায়েট বলে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক প্রায় ২০০০-২৫০০ ক্যালরি সমপরিমাণ খাবার গ্রহণ করতে হয়। তবে রোজার সময় ১০০০ থেকে ১৫০০ ক্যালরি খাবার গ্রহণ যথেষ্ট। কারণ রোজায় অল্প খাবার গ্রহণ করলেই অটোফ্যাজি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরের ক্ষতিকর কোষগুলো পরিষ্কার হয়। তাই অন্যান্য সময় যে পরিমাণ খাবার খাওয়া যায়, রোজায় তার চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম খেতে হবে।
আমাদের ক্যালরিজেনিক খাবারগুলো মূলত তিন ভাগে বিভক্ত ।
– প্রোটিন তথা আমিষজাত খাবার হচ্ছে মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, ইত্যাদি। এক গ্রাম প্রোটিন থেকে ৪ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়।
– ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাবার, বা তৈলাক্ত খাবার। এক গ্রাম ফ্যাট থেকে ৯ ক্যালরি পাওয়া যায়।
নরমাল ব্যালেন্স ডায়েটের মধ্যে খাবারের অনুপাত হচ্ছে,
কার্বোহাইড্রেট : প্রোটিন : ফ্যাট= ৪ঃ১ঃ১
আরও সহজে দৈনিক খাবারের ৬৫% হবে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা (ভাত, মুড়ি, রুটি, আলু, খেজুর, কলা, ছোলা বুট, অন্যান্য ফলমূল) ২৫% হবে প্রোটিন বা আমিষ (মাছ, মাংস, ডিম) ১০% ফ্যাট (তেল)
রোজার সময় ১৫০০ ক্যালরি পেতে হলে যেভাবে খাবেন তাহলো ৬৫% শর্করা, তথা ৯৭৫ ক্যালরি গ্রহণ করা উচিত। ২৫০ গ্রাম শর্করা জাতীয় খাবার। ৬০ গ্রাম প্রোটিন জাতীয় খাবার। ৩০ গ্রাম স্নেহজাতীয় খাবার।
ইফতারি আর রাতের খাবার মিলিয়ে ৬০০-৭০০ ক্যালরি খেতে হবে। আর সাহরিতে ৬০০-৭০০ ক্যালরি। আর যারা ওজন কমাতে চান তারা ইফতারিতে ৩০০ ক্যালরি খাবেন, সাহরিতে ৩০০ ক্যালরি পরিমাণ, সঙ্গে ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার ও পর্যাপ্ত ফাইবার জাতীয় খাবার যেন খাওয়া যায়।
কী খাবেন ও বাদ দেবেন : ইফতারে ৬০০ ক্যালরি পেতে হলে যা খেতে হবে। খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নত। খেজুর শর্করা জাতীয় খাবারের মধ্যে অন্যতম। খেজুরের মধ্যে শর্করা ছাড়াও প্রায় সব ধরনের ভিটামিন ও খনিজ উপাদান রয়েছে, ৪টি মাঝারি (৩৫ গ্রাম) খেজুরের মধ্যে প্রায় ১০০ ক্যালরি রয়েছে। তাই ইফতারিতে ৪-৫টি খেজুর খাওয়া যেতে পারে। ফলমূলের মধ্যে ইফতারিতে কলা অন্যতম। কলায় প্রায় ১০৫ ক্যালরি রয়েছে তাই ইফতারির তালিকায় ১টি করে কলা খাওয়া যেতে পারে। ছোলা বুট খাওয়া যেতে পারে। ৫০ গ্রাম ছোলা বুটের মধ্যে প্রায় ১৮০ ক্যালরি রয়েছে। ছোলা বুট অল্প পরিমাণ খাবে ২০-২৫ গ্রাম। এর চেয়ে বেশি না খাওয়াই ভালো। কারণ এটা পরিপাক হতে দীর্ঘ সময় লাগে। একটা ডিম খাওয়া যেতে পারে, একটা ডিমের মধ্যে ৮০ ক্যালরি রয়েছে। অন্যান্য ফলমূল খাওয়া যেতে পারে, যথা তরমুজ, আপেল, কমলা- এসব পানিশূন্যতা রোধে অনেক উপকারী। ডাবের পানি, ইসপগুলের ভুসি, লেবুর শরবত ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। এইগুলো পানিশূন্যতা রোধে অনেক উপকারী।
ইফতারিতে যা বাদ দেবেন : ইফতারিতে অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার কিংবা তেলে ডুবিয়ে যেসব খাবার তৈরি করা হয় যেমন: পেঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি, চিকেন ফ্রাই, জিলাপি ইত্যাদি যতটুকু সম্ভব পরিহার করতে হবে। কারণ এই খাবারগুলো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা তৈরি করে। একসঙ্গে অনেক বেশি খাবার খেয়ে ফেলা যাবে না। অনেকে ইফতারিতে বসেই খেতে খেতে ইসোফেগাস তথা গলবিল পর্যন্ত খেয়ে ফেলে তা কখনোই করা যাবে না। টক জাতীয় ফলে যদিও প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি থাকে, তথাপি টক জাতীয় ফলে সাইট্রিক অ্যাসিডও থাকে। তাই রোজার সময় টক ফল সাবধানতার সঙ্গে খেতে হবে। ভালো হয় রাতের খাবার শেষ করে খেলে। কারণ সাইট্রিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবারগুলো এসিডিটির পরিমাণ বৃদ্ধি করে। তাই সতর্কতা অবলম্বন দরকার। টমেটো ইফতারির সময় অনেকের প্রিয় খাবার, তবে টমেটোতে প্রচুর পরিমাণ সাইট্রিক অ্যাসিড ও ম্যালিক অ্যাসিড থাকে এবং এটা পাকস্থলীতে ইরিটেশন করে তাই টমেটো বেশি পরিমাণ না খাওয়াই উত্তম। ঝাল খাবার পাকস্থলীতে এসিডিটির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় তাই কাঁচা মরিচ কিংবা অতিরিক্ত ঝাল খাবার পরিহার করে চলতে হবে। গরম খাবার যথা চা, কফি ইত্যাদি পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ক্ষরণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় তাই রোজার সময় চা, কফি ইত্যাদি পরিহার করে চলা উচিত।
রাতের খাবারে যা খাবেন : প্রথমত ইফতারিতে যেই খাবারগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলো খেলে পরে ডিনার করা প্রয়োজন হয় না, তারপরও যদি কারও বেশি ক্ষুধা লাগে এক কাপ পরিমাণ ভাত সঙ্গে মাছ বা ডিম আর ডাল-সবজি খেতে পারেন। অবশ্যই একটা লাইট মিল হতে হবে। অতিরিক্ত খাবার বর্জনীয়। ইফতার করলে পরবর্তী সময় তারাবির নামাজের পরে একটু ক্ষিধে লাগা স্বাভাবিক। তখন অনেক বেশি খেতে মন চায়, কিন্তু তখন হালকা ২-৩টি খেজুর খেলেই ক্ষুধা চলে যাবে। তাই তখন অনেক ভারী খাবারের কোনো দরকার নেই। কারণ এই ক্ষুধা বেশিক্ষণ থাকবে না। ৩০ মিনিট সহ্য করলে এমনিতেই এই ক্ষুধা চলে যাবে।
সাহরির সময় করণীয় : সাহরি শেষে ফজর নামাজের প্রস্তুতি নেওয়া যায় আর ফজর নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে যে ৩০-৪০ মিনিট সময় লাগবে তা খাবার পরিপাকে সহায়তা করে। যদি কেউ ফজরের সময় হওয়ার ১-২ ঘণ্টা আগে সাহরি করে তাহলে সে তো আর সাহরি শেষ করে ২ ঘণ্টা বসে থাকবে না বরং শুয়ে পড়বে আর খাবার খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে যাওয়া এসিডিটির অন্যতম কারণ। তাই দেরিতে সাহরি করা সুন্নত আর সাহরি করে নামাজ পড়ে তারপর ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্যও উত্তম। সাহরির খাবার : ভাত, মাছ বা মুরগি, ডাল, সবজি ইত্যাদি। খুব বেশিও না আবার খুব কম ও না। ২ কাপ পরিমাণ (১০০ গ্রাম) ভাত, সঙ্গে ১ পিস মাছ বা মুরগি, ডাল-সবজি হলেই যথেষ্ট। সম্ভব হলে এক-দুটা খেজুর। অতিরিক্ত ঝাল খাবার, চর্বি জাতীয় খাবার, কিংবা তেলে ভাজা খাবার সাহরিতে খাবেন না। সাহরি শেষ করে সম্ভব হলে ৩-৪ চামচ ইসপগুলের ভুসি দিয়ে এক গ্লাস শরবত গুলে খেতে পারেন।
কারণ ফাইবার জাতীয় খাবারের মধ্যে ইসপগুলের ভুসি অন্যতম। এটা শরীরের মধ্যে পানি ধরে রাখে এবং দিনের বেলায় পানির পিপাসার পরিমাণ কমায়। তাই সাহরির পরে ইসপগুলের ভুসি খাওয়ার অভ্যাস অনেক ভালো। এটা একদিক দিয়ে দিনের বেলায় পানিশূন্যতা কমাবে, অন্যদিকে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্যও এটা উপকারী।
যাদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা : মূলত যাদের এসিডিটির সমস্যা কিংবা গ্যাস্ট্রিক রোগ রয়েছে তারা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেতে পারেন এবং চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে রোজা রাখতে পারবেন আর সঙ্গে সঙ্গে ওপরের নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে।
সতর্কতা : বিভিন্ন রোগী ও তার অসুস্থতার অবস্থাভেদে খাবারের জন্য ডায়েট চার্ট করা জরুরি এবং বিশেষ নিয়ম অনুসরণ করার প্রয়োজন হতে পারে সে ক্ষেত্রে সরাসরি চিকিৎসক কিংবা পুষ্টিবিদ ও ডায়েট বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: চিকিৎসক, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
কিউএনবি/আয়শা/২৫ মার্চ ২০২৩,/রাত ৯:৩০