ডেস্ক নিউজ : বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) মৌখিক পরীক্ষার পরীক্ষকরা (ভাইভা বোর্ড) চাকরিপ্রার্থীর কাছে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানতে চাইতে পারবেন না। এমনকি জেলার নামও না। বোর্ডের সদস্যদের বিশ্ববিদ্যালয়প্রীতি বা জেলাপ্রীতি বন্ধ করার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসি। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রার্থী পেলে বা জেলার প্রার্থী পেলে অনেক পরীক্ষক পাক্ষপাতমূলক আচরণ করেন; যা প্রার্থীর জন্য সুবিধাজনক ক্ষেত্র সৃষ্টি করে বলে মনে করে পিএসসি।
বিসিএসে সব ধরনের কোটা তুলে দেওয়ার পর এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলো কেন জানতে চাইলে কমিশনের একজন সাবেক সদস্য জানান, এক চাকরিপ্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় পেয়েছেন ৫৮৪ নম্বর, অন্যজন ৫৭০। চাকরি হওয়ার কথা প্রথম জনেরই। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় প্রথমজনকে দেওয়া হলো ৮০। আর দ্বিতীয়জনকে ৯৫। এই ফলের ভিত্তিতে দ্বিতীয়জন চাকরি পেয়ে গেলেন। তখন বিসিএসে মৌখিক পরীক্ষার মোট নম্বর ছিল ১০০, পাসের নম্বর ৮০। প্রথমজনকে শুধু পাসের নম্বরটাই দেওয়া হলো।
প্রার্থীকে ভালোভাবে যাচাই করার যুক্তি দিয়ে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ করা হলো। এতে অনিয়মের দুয়ার আরও চওড়া হয়ে গেল। সরাসরি অভিযোগ করার সুযোগ না থাকায় মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ফিসফাসও বেড়ে গেল। কারণ এই পরীক্ষার নম্বর চাকরিতে আকাশ-পাতাল ব্যবধান গড়ে দেয় বলে মনে করেন পিএসসির সাবেক ওই সদস্য।
যদিও পিএসসি মৌখিক পরীক্ষাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। ১০০ নম্বরের যুগে পরীক্ষকদের সামনে প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার নম্বরও থাকত। এখন আর সেই সুযোগ নেই। তারপরও প্রিয়জনপ্রীতির নানা সুযোগ রয়ে গেছে। বোর্ডের কোনো সদস্যের সঙ্গে চাকরিপ্রার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় মিলে গেলে ‘খেজুরে’ আলাপ শুরু হয়। জেলা মিলে গেলে তো কোনো কথাই নেই। নিজের বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র পেলে পরীক্ষকরা যে পরিমাণ খুশি হন অন্য বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্রের বেলায় তারা যেন প্রশ্ন করতেই ভুলে যান। তাদের আড়ষ্টতাই ভাঙে না। অবসাদ নিয়ে অপেক্ষা করেন নতুন প্রার্থীর জন্য।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা জেলা মিলে গেলে প্রায় একই ধরনের পরীক্ষা দিয়ে কেউ পায় ১৮০ আবার কেউবা ১৩০। যেখানে আধা নম্বর (দশমিক ৫) ব্যবধান গড়ে দেয়, সেখানে ৫০ নম্বরের পার্থক্যে কত কিছুই না হয়! ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় শতকরা ৫০ ভাগ হচ্ছে পাস নম্বর। পাস নম্বরে ক্যাডার তালিকায় আসবে কি না নিশ্চিত না হলেও নন-ক্যাডারে নাম থাকে। এতে পরে অন্য সরকারি চাকরিতে সুপারিশ পাওয়ার সুযোগ থাকে। লিখিত পরীক্ষার পর প্রথমে সাধারণ ক্যাডার, তারপর বোথ ক্যাডার এবং শেষে কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারের মৌখিক পরীক্ষা হয়। বোর্ড সদস্যদের মনোনীত করা হয় এলোপাতাড়ি এবং পরীক্ষার দিন সকালেই। এ কারণে দৃশ্যত কোনো ধরনের অসমতা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি পিএসসির চেয়ারম্যানও জানেন না সদস্যদের কে কোন বোর্ডে পরীক্ষা নেবেন।
মৌখিক পরীক্ষার বোর্ড দুই ধরনের হয়। প্রেসিডেনশিয়াল বোর্ডে পিএসসির চেয়ারম্যান থাকেন। এটা প্রথম কয়েক দিন চলে। আর সাধারণ বোর্ডে পিএসসির সদস্য চেয়ারম্যান হন সঙ্গে বাইরের দুজন বিশেষজ্ঞ থাকেন; অর্থাৎ তিনজন মিলে বোর্ড হয়। চেয়ারম্যানসহ পিএসসির সদস্য সাধারণত ১৫ জন হওয়ায় বোর্ডও এর বেশি করার সুযোগ থাকে না। কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারের মৌখিক পরীক্ষার সময় সাধারণত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ থাকেন। বিষয়ভিত্তিক মৌখিক পরীক্ষায় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেশি রাখা হয়। বোর্ডের সামনে প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার নম্বর থাকে না। প্রার্থীকে মূল্যায়ন করা হয় শুধু ২০০ নম্বরের ওপর। প্রার্থী বোর্ড থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চেয়ারম্যান সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নম্বর চূড়ান্ত করেন। এটা করা হয় সদস্যদের প্রত্যেকের দেওয়া নম্বর গড় করে।
পিএসসির মৌখিক পরীক্ষার বোর্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, বোর্ডে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষককে রাখা হয়, কিন্তু অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনও রাখা হয় না; কেন? তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, বোর্ডে একজন প্রশ্ন করবেন, অন্যরা চুপ থাকবেন বিষয়টা এমনও হওয়া উচিত নয়। সবাইকে সমানহারে প্রশ্ন করতে হবে। কতটা প্রশ্ন করবেন বা কত সময় একজন প্রশ্ন করবেন, তা নির্ধারিত থাকতে হবে। তা না হলে এখানেও কারও জন্য সুযোগ তৈরি হবে।
বর্তমান পদ্ধতিতে বোর্ডের চেয়ারম্যান জানতে পারেন প্রার্থীর বৃত্তান্ত। এতে করে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় কি না জানতে চাইলে লুৎফর রহমান বলেন, অবশ্যই এতে সমস্যা হয়। বোর্ডের কোনো সদস্যকেই প্রার্থীর বৃত্তান্ত জানতে দেওয়া যাবে না। পুরোপুরি কোডিং সিস্টেমে চলে যেতে হবে। ২০০ নম্বরের পরীক্ষা নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিতর্ক চলছে। চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, এতে বিশেষ কোনো প্রার্থী সুুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এই ২০০ নম্বরে। এ বিষয়ে লুৎফর রহমান বলেন, মৌখিক পরীক্ষায় ২০০ নম্বর থাকা উচিত নয়। এই নম্বর কমিয়ে আনা উচিত বলে তিনি মনে করেন। প্রায় একই মানের পরীক্ষা দিয়ে অনেকের নম্বরে হেরফের থাকে। মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বেশি হওয়ায় বাছাইকারী অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন। তাই সাংবিধানিক এ সংস্থার কোনো বিতর্কে যাওয়া উচিত নয়।
৪৪তম বিসিএসে অংশগ্রহণকারী একজন চাকরিপ্রার্থী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পিএসসির উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভালো। এই উদ্যোগ ইতিবাচক পরিবর্তনে সহায়তা করবে। বিশ্ববিদ্যালয় বা জেলা কোনো বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার আগের বিসিএসের ভাইভা বোর্ডে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। তিনি আমাকে কোনো প্রশ্নই করলেন না। এমনকি ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রশ্ন করতে বললেও তিনি আমাকে প্রশ্ন করেননি। সেই ভাইভায় আমি কাক্সিক্ষত নম্বর পাইনি।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ চাকরিপ্রার্থী আরও বলেন, কিছু বিষয়ে পিএসসি লক্ষ রাখলে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা উপকৃত হবেন। বোর্ডে ঢোকার পর প্রথম প্রশ্নই হচ্ছে, ‘টেল এবাউট ইউরসেলফ’। আমার নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও আসবে, নিজের জেলার নামও আসবে। কাজেই এমন কোনো প্রশ্নও করা যাবে না, যেখানে ব্যক্তিগত তথ্যের নামে জেলা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলতে বাধ্য হয়।
যেকোনো চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মৌখিক পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সব দেশেই নিয়োগ পরীক্ষায় এটা থাকে। নিয়োগ পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে শেষধাপে মৌখিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। উন্নত বিশ্বে একাডেমিক বিষয়ের গুরুত্ব থাকলেও বাংলাদেশে নিয়োগ পরীক্ষায় এর গুরুত্ব খুব একটা নেই। যদিও এ ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা, উন্নত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার শতকরা ৪ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে সীমিত। বাংলাদেশে এ হার কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ হলেও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এবং অনাকাক্সিক্ষত বৈষম্য থাকবে। পিএসসি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজির অনুসরণ করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক মৌখিকে ২৫ নম্বর বরাদ্দ করেছে। উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নম্বর দেওয়া ১৮ থেকে ২২-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা অধিকাংশের জন্যই সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অবিচার। পিএসসি কি পারে না একই পথে হাঁটতে? বিসিএসেও সংস্কার হচ্ছে, কিন্তু সেটা ধীর। লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে তৃতীয় পরীক্ষক চালু করেছে পিএসসি। আশা করি শিগগির না হলেও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর কমানোর সিদ্ধান্ত আসবে। এ ক্ষেত্রে পিএসসির করণীয় নেই। কারণ পিএসসিকে যেকোনো বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করতে হয়।
কিউএনবি/আয়শা/১৬ জানুয়ারী ২০২৩/বিকাল ৪:০৫