‘ব্যাংলাম্পু’
————-
ব্যাংককে ঢুকলাম দুই মাসের ভিসা নিয়ে। লাওসের রাজধানী ভিয়েনটিয়েনে ফেলে আসলাম কিছু স্মৃতি, কিছু কষ্ট। বিদায় বেলায় মিনার মুখচ্ছবি মাঝে মাঝে আমাকে বিভ্রান্ত করে। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে নিয়ে যেতে চায় আমাকে। মাঝে মাঝে আবার আমি হারিয়ে যাই। বিদায় বেলায় লাওস কন্যার নীরব প্রস্থান আমাকে বিহবলতায় ফেলে দিয়েছে। নীরব প্রস্থান যে একটি কঠিন ভাষার আঁধার হতে পারে, এর আগে তা জানা ছিল না।
দেশ আমাকে টানে, আকর্ষিত করে। দেশের সব খবর নিয়মিত পাচ্ছি। ক্যাম্পাসে ব্যাংকক ফেরত বন্ধুরা তাদের আধিপত্য বিস্তারের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। বন্দুক যুদ্ধ হচ্ছে। আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অশান্ত হয়ে পড়েছে। ঢাকা থেকে কেউ ফিরলে নিউজ পেপার আর হুমায়ুন আহমেদ এর কোথাও কেউ নেই নাটকের ভিসিডি আনতে বলি। বিশেষ করে যারা ল্যাগেজ ব্যবসায়ী তারা আমার এই বিশেষ অনুরোধ টুকু রক্ষা করেন নিয়মিত।
আবারও ব্যাংককের জীবন শুরু হল। আগের মতই। ফাওরাত কেন্দ্রিক এ জীবন বড়ই এক ঘেয়ে লাগে। বান্টি ট্রাভেলস এ বসে বই পড়ি, দুলাল ভাই সহ দুপুরে লাঞ্চ করি। সন্ধ্যা অবধি আড্ডা জমিয়ে তারপর হোটেলে ফিরি । এ যেন আমার ”মেরে ঘর আনা জিন্দেগী”। এরপর ”আপনাম” সেরে ফেলি। থাইল্যান্ডে আপনাম হলো সারাদিন কাজ শেষে ঘরে ফিরে দিনের দ্বিতীয়বারের জন্যে গোসল করা। ব্যাংককে একটা চিরাচরিত দৃশ্য আছে। কাজ শেষে পরিবারের পুরুষরা ঘরে ফিরে আপনাম সেরে সারা শরীর মুখে ট্যালকম পাউডার মেখে রাতের খাবারে বসবে। খাবারের সব মেন্যুর সাথে থাকবে থাইল্যান্ডের স্থানীয় মদ মেকং।
একদিন বিকাল বেলা ”ব্যাংলাম্পু” যেতে হল। ব্যাংকক শহরে দেশভিত্তিক কিছু অঞ্চল গড়ে উঠেছে। যেমন জাওরাত কে লিটল চায়না বলা হয়। চাইনিজ অধ্যুষিত এই এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্য, আবাসস্থল সব কিছুই চাইনিজ স্টাইলে। ঘর বাড়ীর আদল দেখলে মনে হবে এই এলাকাটা যেন কোন চীনের এলাকা। ঠিক তেমনি ফাওরাতকে লিটল ইন্ডিয়া বলা হয়। ভারতীয় ও বাংলাদেশীদের ব্যবসা ও আবাসস্থল। ঠিক তেমনি পাইসানিকাং পাকিস্তান অধ্যুষিত এলাকা। ব্যাংকক শহরের ডিপ্লোমেটিক অঞ্চল সুকুমভিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ট্যুরিস্টদের আনাগোনা বেশি।
কাউবয় খ্যাত খাওসান রোডেই ”ব্যাংলাম্পু” এলাকাটি। ইউরোপিয়ান বা সাদা চামড়ার মানুষদেরকে থাই ভাষায় ফালাং বলে। এই ব্যাংলাম্পুতে ফালাংদের বসবাস। কালো চামড়ার আফ্রিকানরাও এখানে থাকে। ”ব্যাংলাম্পু” নামের অর্থ হল ম্যানগ্রোভ আপেলের এলাকা। লামপু মানে ম্যানগ্রোভ আপেল। স্থানীয় সান্তি চাই প্রাকন পার্কে একটি শেষ নিদর্শন স্বরূপ ম্যানগ্রোভ আপেল গাছ আছে।
পশ্চিমাদের কাছে ব্যাংলাম্পু একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। খাওসান এবং রাম্বুত্রি রোড পর্যটকদের জন্যে খুবই আকর্ষণীয়। গেস্ট হাউস, হোস্টেল, রেস্তোরাঁ, রাস্তার খাবার, বার, ক্যাফে, জামাকাপড় এবং থাই ম্যাসেজ পরিষেবা সহ ভ্রমণ সংস্থাগুলো সহ থাকার ব্যবস্থা এখানে আছে । ব্যাংলাম্পু থাই স্কুল ইউনিফর্ম স্টোরের জন্য একটি কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
এখানে এক ট্রাভেল অফিসে এসেছি একজনের সাথে দেখা করতে। কিন্তু সে নেই। আমি তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছি। কথা বলছি ইংরেজিতে। ট্রাভেল এজেন্সির মালিক একজন আইরিশ। আমি অনর্গল তার সংগে কথা বলে যাচ্ছি। কি কারণে যেন ট্রাভেল এজেন্সির আইরিশ মালিক আমার সঙ্গে গল্প বাড়িয়ে চলেছে। আমার পাশে একজন ফালাং তরুণী বসে আছে। হাফ প্যান্ট, টিশার্ট পড়া তরুণীকে নিঃসন্দেহে অপরূপা বলা যেতে পারে। এক সময় খেয়াল করলাম মন্ত্রমুগ্ধের মত সে আমার আর আইরিশ ম্যানের কথা শুনছে।
আমি আইরিশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রাভেল অফিস থেকে বের হয়ে আসলাম। একটু পরেই শুনতে পেলাম ”এক্সকিউজমি”। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ট্রভেল অফিসে বসা সেই শ্বেত শুভ্র সোনালী কেশী তরুণীটি। আমাকে সরাসরি সে প্রস্তাব দিয়ে বসল, তুমি কি আমার সঙ্গে কফি খাবে ? আমি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলার আগ্রহ অনুভব করছি। আমি হেসে জবাব দিলাম, হোয়াই নট ? লেটস মুভ।
কফি শপে ঢুকেই দুজনের এক টেবিলে বসলাম। তরুণী হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল, আমি সিলভিয়া। কানাডা থেকে এসেছি। কানাডার নোভাস্কোশিয়াতে আমার বাসা। ইউ ফ্রম ? আমি বললাম বাংলাদেশ। সিলভিয়া বিস্ময়ের সঙ্গে ”ওয়াও” বলে উঠল। বাঙ্গালাদেশ ? তোমার দেশের প্রাইম মিনিস্টারকে আমি দেখেছি। ভেরি বিউটিফুল। ভেরি স্মার্ট লেডি। তারপরে সিলভিয়া আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম স্মরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি সিলভিয়ার স্মরণ শক্তির প্রচেষ্টা থামিয়ে দিয়ে বললাম, ”খালেদা জিয়া”।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
কিউএনবি/বিপুল/২৪.১০.২০২২/ রাত ১০.৫৫