ডেস্কনিউজঃ গাইবান্ধা-৫(সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ নানা অনিয়মের কারণে স্থগিত করেছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বুধবার (১২ অক্টোবর) এ উপনির্বাচন স্থাগিত করা হয়। এ সিদ্ধান্তে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টি, বিকল্পধারা ও স্বতন্ত্র দুই প্রার্থী। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী রিপন সংবাদ সম্মেলন করে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বুধবার সকাল ৮ টায় এই আসনে সবগুলো কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোটগ্রহণ শুরু হলেও অধিকাংশ কেন্দ্রগুলোতে সকাল থেকে ভোটারদের উপস্থিতি কম লক্ষ করা যায়। এছাড়া আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য প্রার্থীদের এজেন্টদেরকেও বিভিন্ন কেন্দ্রে দেখতে পাওয়া যায়নি। তবে কিছু কেন্দ্রে নারী ভোটারের উপস্থিতি বেশ উল্লেখযোগ্য।
সরেজমিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কঞ্চিপাড়া এমএইউ একাডেমি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা যায়, ভোটার শূন্য কেন্দ্র। দুই একজন করে এসে ভোট দিচ্ছেন। একই অবস্থা ছিল নাপিতের বাজার ভোটকেন্দ্রে। বেলা ১২ টারদিকে মদনের পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও গিয়ে দেখা যায় একই অবস্থা। পাশের চন্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রেরও একই অবস্থা। এই দুই কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি কম। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোন প্রার্থীর এজেন্ট নেই। উপস্থিত ভোটারদের মধ্যে ছিল এক ধরনের আতঙ্ক ও উদ্বেগ।
হ্যালো সিইসি, গাইবান্ধা থেকে আমরা কী শিখলাম?হ্যালো সিইসি, গাইবান্ধা থেকে আমরা কী শিখলাম?
এনিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চন্দিয়া কেন্দ্রের বাইরে এক চা দোকানদার জানান, গত (মঙ্গলবার) রাতে নৌকার লোকজন অনেককে শাসিয়ে গেছেন ভোটকেন্দ্রে না আসার জন্য। এ কারণে এই অবস্থা।
জানতে চাইলে ওই কেন্দ্রের প্রিজাইটিং কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, অন্য কোন প্রার্থীর এজেন্ট কেন কেন্দ্রে আসে নাই; তা আমি কী করে বলবো।
তিনি আরও জানান, বেলা ১১ টার দিকে কেন্দ্রের বুথে ভোটার ছাড়া কিছু লোকজন ঢুকে ছিল। এ এলাকায় দায়িত্বরত মোবাইল টিমকে খবর দিলে ম্যাজিট্রেটসহ স্ট্রাইকিং ফোর্স এসে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে সাড়ে ১২টার দিকে এই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত হয়ে যায়।
মদনের পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইটিং কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এ কেন্দ্রে নৌকা ছাড়া অন্য কোন প্রার্থীর এজেন্ট আসে নাই।
কোনো কারণ ছাড়াই ইসি ভোটগ্রহণ স্থগিত করেছে: আওয়ামী লীগ প্রার্থীকোনো কারণ ছাড়াই ইসি ভোটগ্রহণ স্থগিত করেছে: আওয়ামী লীগ প্রার্থী
তিনি আরও জানান, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কেন্দ্রে কিছু অজ্ঞাত যুবক ঢুকে পড়ে। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি শান্ত করে। তারপর থেকে ভোট গ্রহণ চলমান আছে। তিনি বলেন, এ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৪৩৬ জন। বেলা ১২টা পর্যন্ত প্রায় ৫ শত ভোট কাস্ট হয়েছে। এরপর এই কেন্দ্র থেকে পাশের চন্দিয়া কেন্দ্রে এসে জানা যায়। ওই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। এরপর একের পর এক ভোট গ্রহণ স্থগিতের ঘোষণায় ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ও উদ্বেগ বাড়তে থাকে। ফলে প্রায় কেন্দ্রগুলো ভোটার শূন্য হয়ে পড়ে। পরে বোনারপাড়া সরকারি কলেজে দুপুর দুইটার পর গিয়ে দেখা যায় ভোটারদের কোন উপস্থিতি নেই।
কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রের মোট ভোটার ৩ হাজার ১৫৪ কিন্তু এ পর্যন্ত ভোট পড়েছে ১ হাজার ১৮২টি।
এদিকে প্রথমে বেলা দশটার পর গাইবান্ধা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আব্দুল মোত্তালিব জানান, ভরতখালি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র, ফুলছড়ি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র ও সাঘাটা উপজেলার রামনগর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের গোপন কক্ষে একাধিক ব্যক্তি প্রবেশ করে ভোটারদেরকে প্রভাবিত করায় ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। এরপর নানা অনিয়মের কারণে পরবর্তীতে দফায় দফায় মোট ৫১টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয় বলে জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম।
অপরদিকে সাঘাটা উপজেলার কাজী আজাহার আলী বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম শহীদ রঞ্জু অভিযোগ তোলেন কেন্দ্র থেকে তাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে এবং ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পরবর্তীতে ঢাকা থেকে অনিয়মের অভিযোগে একের পর এক কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিতের ঘোষণা আসতে থাকে। তখন দুপুর সাড়ে বারোটা। সাঘাটা উপজেলার বগারভিটা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ছাড়া বাকী চার প্রার্থী একত্রিত হয়ে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
ইসির ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তে হতবাক আওয়ামী লীগ!ইসির ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তে হতবাক আওয়ামী লীগ!
ভোট বর্জনকারী চার প্রার্থী হলেন-জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী এ এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জু (লাঙল), বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান (ট্রাক)।
চার প্রার্থীর পক্ষে জাতীয় পার্টির গোলাম শহীদ রঞ্জু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ভোট কারচুপি ও কেন্দ্র দখলসহ গোপন কক্ষে ঢুকে ভোট দেওয়া এবং তাদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে। আবার নির্বাচন কমিশন অনিয়মের কারণে অনেক কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করেছে। তাই আমরা ভোট বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে গাইবান্ধা -৫ আসনের সব কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিতের নির্দেশ চলে আসে।’
ভোট বন্ধের সিদ্ধান্ত আসলে স্বস্তি প্রকাশ করে জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম শহীদ রঞ্জু বলেন, ‘এটি একটি প্রহসনের নির্বাচন হচ্ছিল। নির্বাচন কমিশনের ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তকে ধন্যবাদ জানাই ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। একইসঙ্গে নতুন তফসিল ঘোষণা করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি জানাই যেন ভোটাররা সুষ্ঠুভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
উপনির্বাচন বন্ধ করলেন অসহায় সিইসিউপনির্বাচন বন্ধ করলেন অসহায় সিইসি
তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার কোন কর্মী বা সমর্থক কোন প্রার্থীর এজেন্টকে কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা বা কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়নি।’
পরে বিকাল ৫ টার দিকে সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘কোন বাস্তবসম্মত যুক্তিগত কারণ ছাড়াই নির্বাচন কমিশন প্রথমে বেশ কিছু কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করে। পরে বেলা আড়াইটার দিকে অজ্ঞাত কারণে নির্বাচন কমিশন পুরা এলাকার ভোটগ্রহণ বন্ধ করে। যা সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তের আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সব প্রার্থী নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। তারেই ধারাবাহিকতায় আজ ১২ অক্টোবর সকাল থেকে সাধারণ ভোটারা ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট প্রদান করে আসছিলেন। ভোট গ্রহণ চলাকালে কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কোন সংঘর্ষের ঘটনাও হয়নি। তারপর অজ্ঞাত কারণে বেলা আড়াইটার দিকে নির্বাচন কমিশন পুরো এলাকার ভোট বন্ধ করে। যা ভোটার ও সাধারণ জনগণকে বিস্মিত ও হতবাক এবং ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত করেছে। তবুও বৃহত্তর স্বার্থে আমরা জনগণকে শান্ত করেছি। আমি নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাতে চাই-যেসব কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। অবিলম্বে সেই সব কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করা হোক। আর যে সব কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত ছিল সেসব কেন্দ্রের ভোট পুনরায় গ্রহণ করা হোক ‘
প্রসঙ্গত, এ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী গত ২৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এরপর আসনটি শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
কিউএনবি/বিপুল/১২.১০.২০২২/ রাত ৯.৩৮