
ডেসক্ নিউজ : দেশের ৩৪ জেলায় গণহত্যা-বধ্যভূমি-গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৭ হাজার ২৮৬। এর মধ্যে গণহত্যা চালানো হয়েছে এমন দুই হাজার নতুন স্থানের সন্ধান মিলেছে। এসব স্থানের নাম আগে কোথাও পাওয়া যায়নি। ৩৪ জেলার ওপর গণহত্যা বিষয়ক জরিপ ও গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ জরিপ ও গবেষণার কাজটি করছে। এতে পাকহানাদার বাহিনীর বর্বরতার নতুন নতুন দিক উঠে আসছে। ৬৪ জেলায় এ কাজ চলছে।
গণহত্যা জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন যুগান্তরকে বলেন, সব মিলিয়ে আমরা যে তথ্য পাচ্ছি তাতে শহিদের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি হবে। এর মধ্যে শরণার্থী শিবিরে যারা মারা গেছেন তারাও আছেন। আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনা পাঁচ লাখের উপরে। হাইকোর্টের একটি রায়ও আমার এই গবেষণার সংখ্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ৩৪টি জেলায় গণহত্যা ১৪৪৫২টি, বধ্যভূমি ৭৫৯টি, গণকবর ১০৪৮টি এবং নির্যাতন কেন্দ্র ১০২৭টি। বিভিন্ন জেলার তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি গণহত্যা হয়েছে দিনাজপুরে ১৭২৬টি।
সবচেয়ে বেশি গণকবর পাওয়া গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৮০টি। এর মধ্যে রাজশাহীতে সর্বাধিক শতাধিক নির্যাতন কেন্দ্রের সন্ধান মিলেছে। তাতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে প্রতি বর্গমাইলে গণহত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গণহত্যা জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন যুগান্তরকে বলেন, গণহত্যা জাদুঘর থেকে আমরা ৩৪টি জেলায় জরিপ কাজ সম্পন্ন করেছি। গণহত্যা, গণকবর, নির্যাতনকেন্দ্র আর বধ্যভূমি নিয়ে এই জরিপ ও গবেষণা চালানো হয়েছে। যেখানে এই জেলাগুলোতে সবমিলিয়ে ১৭২৮৬টি ঘটনা পাওয়া গেছে। উদাহরণ দিয়ে এই গবেষক বলেন, খুলনার প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস এলাকায় যুদ্ধকালীন ২৯৩ দিনের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সেখানে প্রতিদিনই ৫-১৫ জন মানুষ হত্যা করা হয়।
যদি ২৯৩ দিন না ধরে ১০০ দিনও ধরি তা হলেও সেখানে ১০০টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, গণহত্যার কোনো সঠিক হিসাব হয় না আনুমানিক। প্রত্যেক উপজেলায় গিয়ে মাঠ পর্যায়ের গবেষণার ভিত্তিতে পাওয়া গেছে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রতি বর্গমাইলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা গণহত্যা জাদুঘর থেকে প্রতিটি গণহত্যার ওপর একটি করে বই প্রকাশ করছি। গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি ও ট্রাস্ট সম্পাদক ড. চৌধুরী শহীদ কাদের যুগান্তরকে বলেন, এই নতুন ফলাফলে শহিদের সংখ্যা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকবে না।
সব ধরনের বিতর্কেরও অবসান হবে নিঃসন্দেহে। ৩৪টি জেলায় কীভাবে ১৪৪৫২টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সে বিষয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। এখানে আমরা একটি গবেষণা কৌশল অবলম্বন করেছি। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ১০ নভেম্বর ছাড়াও একাত্তরের নানা সময়ে গণহত্যা হয়েছে। একইভাবে ফয়’স লেক ঝাউতলায় গণহত্যা হয়েছে ৬০ দিন। এতদিন এগুলোকে একটি গণহত্যা হিসাবে দেখানো হয়েছে। আমরা এখানে ৬০টি গণহত্যা হিসাবেই ধরেছি। তিনি বলেন, আমাদের জরিপ ও গবেষণার সবচেয়ে বড় ফলাফল হলো, ৩৪টি জেলায় আমরা প্রায় ২০০০টি গণহত্যার স্থান পেয়েছি যেগুলোর কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কেউ নাম-ই জানত না। ঠাকুরগাঁওয়ে ৫৩৮ জন শহিদের নাম পেয়েছি যাদের কথা কোনো বইতেও নেই।
এদিকে ৩৪ জেলার গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতনকেন্দ্রের যে চিত্র পাওয়া যায় তা হলো : পাবনা (গণহত্যা : ৭৫, বধ্যভূমি : ২৬, গণকবর : ১২, নির্যাতনকেন্দ্র : ১৩, মোট : ১২৬), পঞ্চগড় (গণহত্যা : ৬৪৯, বধ্যভূমি : ৪, গণকবর : ১৭, নির্যাতনকেন্দ্র : ২৩, মোট : ৬৯৩), কুড়িগ্রাম (গণহত্যা : ১৫, বধ্যভূমি : ১৫, গণকবর : ১২, নির্যাতনকেন্দ্র : ৪২, মোট : ৮৪টি), মৌলভীবাজার (গণহত্যা : ৩১৭, বধ্যভূমি : ২৬, গণকবর : ১৫, নির্যাতন কেন্দ্র : ১৮, মোট : ৩৭৬টি), গাইবান্ধা (গণহত্যা: ১৩৬, বধ্যভূমি : ৯, গণকবর : ১০, নির্যাতনকেন্দ্র : ৮, মোট : ১৬৩টি), যশোর (গণহত্যা : ৫৮৯, বধ্যভূমি : ৩৯, গণকবর : ৩৩, নির্যাতনকেন্দ্র : ৩৬, মোট : ৬৯৭টি), জামালপুর (গণহত্যা : ১৯২, বধ্যভূমি : ২২, গণকবর : ৩৩, নির্যাতনকেন্দ্র : ২১, মোট : ২৬৮টি), লালমনিরহাট (গণহত্যা : ৫৬২, বধ্যভূমি : ১৮, গণকবর : ৮, নির্যাতনকেন্দ্র : ১৩, মোট : ৬০১টি), নড়াইল (গণহত্যা : ১৪৯, বধ্যভূমি : ৩, গণকবর : ৪, নির্যাতনকেন্দ্র : ৫, মোট : ১২৬টি), ব্রাহ্মণবাড়িয়া (গণহত্যা : ৩৪৩, বধ্যভূমি : ৩৫, গণকবর : ১৮০, নির্যাতনকেন্দ্র : ৯২, মোট : ৬৫০), বরিশাল (গণহত্যা : ২৪০, বধ্যভূমি : ২০, গণকবর : ২৩, নির্যাতনকেন্দ্র : ২৩, মোট : ৩০৬), মুন্সীগঞ্জ (গণহত্যা : ১৪৫, বধ্যভূমি : ৭, গণকবর : ৬৫, নির্যাতনকেন্দ্র : ১৭, মোট : ২৩৪), কক্সবাজার (গণহত্যা : ১৯৫, বধ্যভূমি : ২০, গণকবর : ২৯, নির্যাতনকেন্দ্র : ২৩, মোট : ১৬৭টি), চট্টগ্রাম (গণহত্যা : ৬০৩, বধ্যভূমি : ৯৫, গণকবর : ৬২, নির্যাতনকেন্দ্র : ৮৮, মোট : ৮৪৮), দিনাজপুর (গণহত্যা : ১৭২৬, বধ্যভূমি : ৩২, গণকবর : ৩৪, নির্যাতনকেন্দ্র : ৬৫, মোট : ১৮৫৭টি), ঠাকুরগাঁও (গণহত্যা : ৪০৯, বধ্যভূমি : ১৩, গণকবর : ১৪, নির্যাতনকেন্দ্র : ১১, মোট : ৪৪৭), টাঙ্গাইল (গণহত্যা : ৫৪৫, বধ্যভূমি : ১৬, গণকবর : ৭৬, নির্যাতনকেন্দ্র : ২৩, মোট : ৬৬০টি), গাজীপুর (গণহত্যা : ৬৯২, বধ্যভূমি : ২৯, গণকবর : ২৩, নির্যাতনকেন্দ্র : ২৮, মোট : ৭৭২টি), নওগাঁ (গণহত্যা : ১৬০০, বধ্যভূমি : ৫১, গণকবর : ১৮, নির্যাতনকেন্দ্র : ১৫৪, মোট : ১৮২৩টি), চাঁপাইনবাবগঞ্জ (গণহত্যা : ৫১২, বধ্যভূমি : ১১, গণকবর : ৫১, নির্যাতনকেন্দ্র : ৩০, মোট : ৬০৪টি), সিরাজগঞ্জ (গণহত্যা : ৫৭৯, বধ্যভূমি : ১৫, গণকবর : ৮৫, নির্যাতনকেন্দ্র : ২৯, মোট : ৭০৮টি), চুয়াডাঙ্গা (গণহত্যা : ৬৯৫, বধ্যভূমি : ১৬, গণকবর : ১৭, নির্যাতনকেন্দ্র : ১৭, মোট : ৭৪৫), ফরিদপুর (গণহত্যা : ৬৭৮, বধ্যভূমি : ৭, গণকবর : ২৩, নির্যাতনকেন্দ্র : ১৫, মোট : ৭২৩টি), ময়মনসিংহ (গণহত্যা : ৩৪২, বধ্যভূমি : ৩৩, গণকবর : ৩১, নির্যাতনকেন্দ্র : ২৩, মোট : ৪২৯টি), রাজবাড়ী (গণহত্যা : ৪৮০, বধ্যভূমি : ১৪, গণকবর : ২২, নির্যাতনকেন্দ্র : ১১, মোট : ৫২৭টি), নরসিংদী (গণহত্যা : ৩২২, বধ্যভূমি : ২৬, গণকবর : ১২, নির্যাতনকেন্দ্র : ৩৪, মোট : ৩৯৪টি), নীলফামারী (গণহত্যা : ১১, বধ্যভূমি : ৩৭, গণকবর : ১৭, নির্যাতনকেন্দ্র : ২০, মোট : ৮৫টি), ভোলা (গণহত্যা : ৩৭, বধ্যভূমি : ৫, গণকবর : ১৭, নির্যাতনকেন্দ্র : ১৫, মোট : ৭৪টি), নারায়ণগঞ্জ (গণহত্যা : ২০৯, বধ্যভূমি : ২৩, গণকবর : ১০, নির্যাতনকেন্দ্র : ৪৬, মোট : ২৮৮টি), সাতক্ষীরা (গণহত্যা : ১৫, বধ্যভূমি : ১১, গণকবর : ৮, নির্যাতনকেন্দ্র : ৭, মোট : ৪১টি), বগুড়া (গণহত্যা : ৪৫, বধ্যভূমি : ৩৩, গণকবর : ২০, নির্যাতনকেন্দ্র : ৪১, মোট ১৩৯টি), রাজশাহী (গণহত্যা : ১২৭, বধ্যভূমি : ৯, গণকবর : ২৬, এখানে নির্যাতনকেন্দ্র ১০০-এরও বেশি, মোট : ২৬২টি), নাটোর (গণহত্যা : ৬৩, বধ্যভূমি : ১৮, গণকবর : ২২, নির্যাতনকেন্দ্র : ০৪, মোট : ১০৭টি), খুলনা (গণহত্যা : ১১৫৫, বধ্যভূমি : ২৭, গণকবর : ৭, নির্যাতনকেন্দ্র : ৩২, মোট : ১২২১টি) প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার জরিপ নামে একটি জরিপ করেছিল এবং তার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে প্রতিদিন গড়ে ৬০০০ থেকে ১২০০০ মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। এ হার গণহত্যার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘ অনুমিত সর্বোচ্চ গড় ধরলেও বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি।
কিউএনবি/আয়শা/২৫শে মার্চ, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ/সকাল ১০:৫১