বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৪৩ অপরাহ্ন

একটি কণ্ঠে বেজে উঠেছিল জাতির কণ্ঠস্বর

Reporter Name
  • Update Time : সোমবার, ৭ মার্চ, ২০২২
  • ৮৬ Time View

 

ডেস্ক নিউজ : আজ থেকে ৫১ বছর আগে আজকের এই দিনে ‘গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার অমর কবিতা শুনিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১-এর ৭ মার্চের পড়ন্ত বিকেলের অপ্রতিরোধ্য বজ্রকণ্ঠ দ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে। ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ’ তাঁর বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কবিতা।

যে কবিতার জন্য রেসকোর্সের ১০ লক্ষাধিক উদ্বেলিত জনতা সেদিন অধীর আগ্রহে অপোয় ছিল, যে কবিতার জন্য বাঙালি ২৩ বছর ধরে নিজেদের প্রস্তুত করছিল। সেই মহৎ কবিতায় সেদিন একটি কণ্ঠে বেজে উঠেছিল জাতির কণ্ঠস্বর। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত এই অঞ্চলের মানুষ একটি ভাষণ শুনেছিল। যে মানুষটি সেই ১৯৪৮ থেকে শুরু করে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়ে ধাপে ধাপে সেই মহাজাগরণের ডাকটি দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন ইতিহাসের সমান্তরালে। আর ক্রমান্বয়ে দেশের মানুষকে প্রস্তুত করেছেন সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এক মহাজাগরণে শামিল হয়ে স্বাধীনতার লগ্নে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে, তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কোনো সামরিক কর্মকর্তার ঘোষণায় এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি সুদীর্ঘ ও সুপরিকল্পিত ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংগ্রামের অনিবার্য গন্তব্য।

৭ই মার্চের ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জাতিকে সুস্পষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান এবং পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা দেন। জনতার মুহুর্মুহু গর্জনে প্রকম্পিত সেদিনের রেসকোর্স ময়দান ছিল স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ও প্রত্যয়দীপ্ত। এই প্রত্যয় একদিনের জন্য নেয়নি। একেকটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে একটি মিলনের মোহনায় এনে দাঁড় করিয়েছিলেন। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তার চূড়ান্ত প্রতিফলন দেখা যায়। একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আগ মুহূর্তে হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে যায় ঢাকা বেতার। গভীর রাত পর্যন্ত এই কেন্দ্র আর খোলেনি। রাতে টেলিভিশনও (ঢাকা কেন্দ্র) বন্ধ থাকে। এ কারণে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ঢাকা বেতার থেকে সরাসরি সম্প্রচার করার সিদ্ধান্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। অবশ্য পরদিন ৮ মার্চ সকালে বাঙালি জাতি ঢাকা বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণ একযোগে শুনতে পায়।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ সম্প্রচার না করার খবর শুনে রেসকোর্সের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায় আসা উজ্জীবিত জনতা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও মারমুখী হয়ে ওঠে। একইভাবে শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করায় ঢাকা বেতারের কর্মীরা স্লোগান দিতে দিতে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসেন এবং সাধারণ জনতার সঙ্গে রেসকোর্সের সমাবেশে যোগ দেন। একাত্তরের ৮ মার্চ দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক ও আজাদে এ সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরদিন গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণ সরাসরি ঢাকা বেতার মারফত প্রচার করার দাবি উঠেছিল আগে থেকেই। সারা দেশের মানুষ যাতে আগে থেকেই শুনতে পায়, তার জন্য বেতারে কর্মরত বাঙালি কর্মীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়, এই ভাষণ তারা সরাসরি সম্প্রচার করবে। রেডিওতে এ সংক্রান্ত ঘোষণাও দেওয়া হয়।

৭ই মার্চ দুপুর ২টা ১০ মিনিট থেকে ৩টা ২০ মিনিট পর্যন্ত বেতারে দেশাত্ববোধক গান পরিবেশন করা হয়। এ পর্যায়ে শেষ গানটি ছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এর পরই ঢাকা বেতার হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে যায়। গভীর রাত পর্যন্ত এই কেন্দ্র আর খোলেনি। রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনও (ঢাকা কেন্দ্র) বন্ধ থাকে। তখন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজির জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্ব পালন করতেন সিদ্দিক সালিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি জেনারেল নিয়াজির পাশেই ছিলেন। তাঁর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘সেই চূড়ান্ত সন্ধিক্ষণ হাজির হলো। মুজিবের ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল ২টা ৩০ মিনিটে (স্থানীয় সময়)। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র মুজিবের ভাষণ নিজ উদ্যোগে সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা সম্পন্ন করল। রেডিওর ঘোষকরা আগে থেকেই রেসকোর্স থেকে ইস্পাতদৃঢ় লাখো দর্শকের নজিরবিহীন উদ্দীপনার কথা প্রচার করতে শুরু করল।

 

এ ব্যাপারে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর হস্তক্ষেপ করল এবং এই বাজে ব্যাপারটি বন্ধ করার নির্দেশ দিল। আমি বেতার কেন্দ্রে আদেশটি জানিয়ে দিলাম। আদেশটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনের অপর প্রান্তের বাঙালি বন্ধুটি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, আমরা যদি সাড়ে সাত কোটি জনগণের কণ্ঠকে প্রচার করতে না পারি তাহলে আমরা কাজই করব না। এই কথার সঙ্গে সঙ্গে বেতার কেন্দ্র নীরব হয়ে গেল। ’অন্যদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে সমাবেশে যোগ দেওয়া বেতারকর্মীরা কাজে ফিরে যেতে অস্বীকার করেন। গভীর রাতে এ ব্যাপারে ঢাকা বেতারের কর্মীরা সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি বৈঠকে বসেন। তাঁরা পরদিন (৮ মার্চ) বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণের কোনো প্রকার কাটছাঁট ছাড়া পুনঃপ্রচারের দাবি জানান এবং দাবি পূরণ হলে তাঁরা কাজে ফিরে যাবেন বলে ঘোষণা দেন।

বেতার কর্তৃপক্ষ এই দাবি মেনে নিয়ে পরদিন ৮ মার্চ সকালেই বঙ্গবন্ধুর আগের দিনের দেওয়া ভাষণটি কাটছাঁট ছাড়া প্রচার করে এবং সারা বাঙালি জাতি ঢাকা বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণ একযোগে শুনতে পায়। তা থেকে বাঙালি পেয়েছিল নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যরে প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তির স্বপ্ন তাদের নতুনভাবে তাড়িত করল, তাদের আলোড়িত ও উজ্জীবিত করল। সেই ভাষণ আজও বাঙালির শ্রেষ্ঠতম সঞ্জীবনী শক্তি।  

ভাষণের শেষে এসে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বস্তুত এরপর স্বাধীনতা ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতাটুকুই শুধু বাকি ছিল। সমাবেশস্থলের আশপাশে তথা ঢাকার আকাশে তখন সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার উড়ছিল। সমাবেশস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে হামলার প্রস্তুতি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর। সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে নিশ্চিতভাবেই লাখ লাখ মানুষের জীবনের ওপর ঝুঁকি নেমে আসত।  

যদিও তাঁর যা যা বলা দরকার ছিল, ১৮ মিনিটের ওই ঐতিহাসিক ভাষণে তাঁর সবই তিনি বলে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সব কিছুই মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চলছিল। এর আগে ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই সভায় বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা করেছিলেন এবং ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের আহূত জনসভায় চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে তাঁর বক্তৃতা শেষ করেছিলেন। সেই কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, যার প্রকাশ ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণে জাতি তথা সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে প্রতিভাত হয়েছিল। ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি’ বলে সেদিন তিনি যে হুকুম দিয়েছিলেন, তারই ফল ১৬ই ডিসেম্বরের মহান বিজয় এবং আমাদের এই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

লেখক : আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য

 

 

কিউএনবি/আয়শা/৭ই মার্চ, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ/বিকাল ৪:১৯

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

December 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৬
IT & Technical Supported By:BiswaJit