আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বাংলাভাষী মানুষদের হেনস্থার অভিযোগে দিল্লিসহ আশপাশের থেকে দ্রুত কমতে শুরু করেছে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা। একই অবস্থা নয়ডা, গুরুগ্রামের মত বৃহত্তর দিল্লির একাংশ। এর ফলে ওই সমস্ত এলাকায় গৃহকর্মীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে, যার ফলে সেই সব মানুষের প্রদেয় পরিষেবার উপর নির্ভরশীল কয়েক শতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি দক্ষিণ দিল্লির কিছু অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আর এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরছে জরুরি বার্তা ‘জরুরিভাবে রাঁধুনি এবং গৃহকর্মী প্রয়োজন’।
গত কয়েকদিন ধরেই নয়ডার গৌর সিটি ৭ম অ্যাভিনিউ সোসাইটির বাসিন্দাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এই বার্তাটি ঘুরে বেড়াচ্ছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে, আশেপাশের সোসাইটির যে সমস্ত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে তাতেও এই ধরণের ‘জরুরি ভিত্তিক’ বেশ কিছু বার্তা এসে পৌঁছেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই খবর সামনে এসেছে।
হঠাৎ করেই দিল্লিসহ আশপাশের এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পিছনে মূলত দুইটি কারণ রয়েছে, প্রথমত অবৈধভাবে যেসব বাংলাদেশি ভারতে অবস্থান করছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই একাধিক মানুষকে আটক করেছে দিল্লি পুলিশ। তাদের বেশ কিছুকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে, আবার কাউকে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ফলে পুলিশের ধরপাকড়ের হাত থেকে বাঁচতে সেই সমস্ত বাংলাভাষী মানুষ দিল্লি ত্যাগ করছেন। দ্বিতীয়ত বিহারের মতো পশ্চিমবঙ্গেও আসন্ন বিধানসভার নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেই কারণেই বহু পরিযায়ী শ্রমিক রাজ্যে ফিরে আসছেন।
নয়ডার হাইবতপুর বস্তিতে অবস্থানকারী নুরজাহান নামে এক নারী স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান, তিনি নয়ডার গৌড় সিটিতে পরিচারিকার কাজ করতেন। তার বস্তি থেকে ইতিমধ্যেই একাধিক বাংলাভাষী মানুষ অন্যত্র চলে গেছে। ফলে তার পরিবারও পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকিট বুক করেছে।’
হাসান শেখ নামে এক পরিযায়ী শ্রমিকের অভিযোগ, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে মারধর করা হয়। পরে গুরুগ্রাম থেকে পালিয়ে যান তিনি।
গুরুগ্রাম থেকে ফিরে আসা আরেক শ্রমিক কাসম মিয়া দাবি করেন যে পুলিশ পরিচয় যাচাই করার জন্য তার পোশাক খুলে ফেলে।
২০১৬ সালে ভারতের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু সংসদে একটি তথ্য দিয়ে দাবি করেছিলেন, ভারতে ২ কোটির বেশি বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী রয়েছেন। তার অভিমত ছিল, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ এবং বিস্তার দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। যদিও কারো কারো অভিমত সরকারের এই দমন-পীড়ন পদক্ষেপ মানবিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বছর ঘুরলেই ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জিও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালি বিদ্বেষের অভিযোগ তুলে ওই সমস্ত রাজ্য থেকে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
জুলাইয়ের শেষে মমতাকে বলতে শোনা যায়, ‘মুম্বাই, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা, আসামে থাকার কোন দরকার নেই। যারা ভালোবাসে না, যারা আপনাদের চায় না, আপনারা কেন সেখানে থাকবেন? আপনারা বাংলায় ফিরে আসুন, আপনাদের দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। আপনাদের বাঁচার সুযোগ করে দেয়া হবে।’ মমতার আশ্বাস ‘আমরা হয়তো বিরিয়ানি বা পিঠে-পায়েশ দিতে পারবো না, কিন্তু আমরা একখানা রুটি খেলে আপনাদের আধখানা রুটি দিতে পারবো। আপনাদের মনে শান্তি থাকবে।’
কর্পোরেট এবং আইটি হাব বলে পরিচিত নয়ডা এবং গুরুগ্রাম- যেখানে বিপুল সংখ্যক কর্পোরেট কর্মীর বসবাস। তারা মূলত পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল- তা সে স্যানিটেশন কর্মী হোক বা গাড়ি পরিষ্কার থেকে শুরু করে গৃহকর্মী।
কারো কারো অভিমত, পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর দমন-পীড়নের ফলে দিল্লি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় কর্মসংস্থান, পণ্য ও পরিসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে যেমন প্রভাব পড়েছে তেমনি দিল্লির মতো কসমোপলিটন শহরের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গ্রেটার নয়ডার গৌড় শহরে অন্তত ১৬টি সোসাইটি রয়েছে, যেখানে উঁচু উঁচু বহুতল ভবনের ঠিক পেছনেই হাইবতপুরে কয়েক একর জুড়ে রয়েছে ঝুপড়ি। এই বস্তিতে বসবাস করে কয়েক শতাধিক পরিযায়ী শ্রমিক, যাদের বেশিরভাগই হয় পশ্চিমবঙ্গ না হয় বিহারের বাসিন্দা। এই শ্রমিকদের উপরই নির্ভরশীল কর্পোরেট পরিবারগুলি।
হাইবতপুরে সেই বস্তির অনেক ঘরই এখন তালাবন্ধ। নিজেদের আর্থিক স্বাধীনতার প্রত্যাশা, ভাড়া করা কোয়ার্টার, জিনিসপত্র, পোশাক-আশাক এবং সন্তানদের পড়াশোনা জলাঞ্জলি দিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়েছে সেসব বাসিন্দারা।
পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার বাসিন্দা নূরজাহানের এক আত্মীয়কে ১০ দিন আগে গুরুগ্রাম পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। এরপর তার স্থান হয় ‘হোল্ডিং সেন্টার’এ। সেখানে আটকে রাখার পরই প্রাণ ভয়ে নুরজাহানসহ নয়ডায় বসবাসকারী প্রায় ৪৫-৫০ জন গৃহকর্মী তাড়াহুড়ো করে রাজ্যে ফেরার জন্য ট্রেনের টিকিট বুক করেছেন।
নূরজাহান স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, নয়ডা পুলিশ আমাদের ১৫ আগস্টের মধ্যে এলাকা খালি করতে বলেছে। আমরা ৭-৮ বছর ধরে এখানে বাস করছি। আমরা বাংলায় কথা বলি ঠিকই, কিন্তু তাই বলে আমরা বাংলাদেশি নই। আমাদের কাছে আধার কার্ডসহ সমস্ত বৈধ নথি আছে। তবুও আমরা কোনো সমস্যায় পড়তে চাই না বলেই আমরা গ্রামে চলে যাচ্ছি।’
গুরুগ্রামের সোসাইটিতে গাড়ি পরিষ্কারের কাজ করতেন হাসান শেখ এবং গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন তার স্ত্রী। ভেবেছিলেন সমস্ত ঝড় ঝাপটা মোকাবিলা করে সেখানেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন কিন্তু পুলিশ তাকে তার বস্তি থেকে তুলে নেওয়ার পর সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হন তিনি। গত ২৬ জুলাই হাসান শেখ সহ প্রায় ২৫০ জনকে আটক করে পুলিশ একটি ‘হোল্ডিং সেন্টারে’ নিয়ে যায়।
হাসানের দাবি, পুলিশ তাকে এতটাই মারধর করেছে যে পরের দিন যখন তাকে এবং আরও কয়েকজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তখন তিনি হাঁটতেও পারছিলেন না। সহকর্মীদের কাঁধে করে ঘরে ফিরতে হয়েছিল তাকে। এরপরই সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্যে ফিরে আসার। সেই মতো পর তিনি টিকিট কেটে রাজ্যে ফিরে আসেন তিন সন্তানের বাবা হাসান।
স্বাভাবিকভাবেই, ব্যস্ত জীবনযাত্রার কারণে কর্পোরেট জগতের সেইসব মানুষরা নিজেদের গৃহস্থালির কাজের জন্য যে শ্রমিক শ্রেণীর উপর নির্ভরশীল- তাদের চলে যাওয়ার কারণে বিকল্প পথের সন্ধান করছেন। বেশ কয়েকটি সোসাইটি তাদের বাসিন্দাদের গৃহকর্মী নিয়োগের সময় পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে।
কিউএনবি/অনিমা/১২ আগস্ট ২০২৫/রাত ১০:০৩