ডেস্ক নিউজ : জুলাই-আগস্টে গণহত্যা চালিয়ে ক্ষমতা হারানোর এক বছর পরও আওয়ামী লীগ তাদের সরকারের পতনের ঘটনাকে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। দলটির বক্তব্য হচ্ছে— দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে।
তবে জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনে দমননীতি চালানো ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগের অনুশোচনা প্রকাশের কোনো ইঙ্গিত এখনো নেই। এ নিয়ে রাজনীতিতে সমালোচনা রয়েছে।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদক কাদির কল্লোলের প্রতিবেদনে এসব তত্ত্ব উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাড়ে পনেরো বছরের দীর্ঘ শাসনামলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার অহংকারে রাজনীতি বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো এবং এমনকি সাধারণ মানুষকেও ক্ষেপিয়ে তুলেছিল।
সেই পটভূমিতে পতনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের দমননীতির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।
এছাড়া বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ যে দলগুলো বর্তমানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারও আওয়ামী লীগ বিরোধী অবস্থানে রয়েছে।
৭৬ বছরের আওয়ামী লীগ এবার সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে বলে রাজনীতিতে আলোচনা আছে। কারণ দলটির শীর্ষ নেতাসহ নেতৃত্বের বড় অংশ দেশ ছেড়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে আছেন।
দলটির সাবেক মন্ত্রী, এমপিসহ নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ গ্রেফতার হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন মামলায় বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন।
দেশের ভেতরে থাকা নেতা-কর্মীরাও এক বছরে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। রাজনীতির মাঠে থেকে দলকে সংগঠিত করতে কোনো নেতা এখনো সাহস দেখাতে পারেননি।
প্রশ্ন হচ্ছে, চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভুল স্বীকার বা কোনো অনুশোচনা না করে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার ওপর ভরসা করে দলটির পক্ষে সহসাই ঘুরে দাঁড়ানো কী সম্ভব?
আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, দলটিতে এখনো শেখ হাসিনার একক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তার নেতৃত্বেই দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা চলছে।
তবে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দলের রাজনীতিতে আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় হয়েছেন। দলটির নেতাদের অনেকের ধারণা, তাদের নেত্রীর নেতৃত্বে সজীব ওয়াজেদ জয়কে সামনে রেখে দলটির ভবিষ্যত পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এখন ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই সরকার আওয়ামী লীগ ও এর মিত্র দলগুলোর এ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ রাখছে না এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন হবে না, এই বক্তব্য নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত দলটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ও দেশের ভেতরে জনমত তৈরির চেষ্টা করবে বলেও এর নেতারা বলছেন।
তারা মনে করেন, যেহেতু আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বড় অংকের ভোট আছে, সে কারণে নির্বাচনে তাদের দলকে বাইরে রাখা হলে তা বড় ইস্যু হবে।
কিন্তু দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে এখন ব্যাপক তৎপর হলেও মাঠের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান নেই। এমন কঠিন বাস্তবতায় নির্বাচন ঘিরে মাঠে দলটি সক্রিয় হওয়ার কোনো সুযোগ পাবে কি না, এই প্রশ্নও রয়েছে বিশ্লেষকদের।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ভরসা কেন
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে গণঅভ্যত্থানের কৃতিত্বের দাবি নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সক্রিয় দলগুলো এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন সংগঠন বিতর্কে জড়িয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।
তাদের পালটাপালটি দাবিতে এক ধরনের বিভক্তিও তৈরি করছে। এই পরিস্থিতিটাকে আওয়ামী লীগ তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে। দলটি জুলাই-অগাস্টের আন্দোলন দমনের চেষ্টার ক্ষেত্রেও জামায়াত-শিবিরসহ বিভিন্ন পক্ষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিল। আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পরও তারা ঘটনাপ্রবাহকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবেই সামনে আনে।
এখন সেই আন্দোলনের কৃতিত্বের দাবি নিয়ে এর অংশীজনদের বিভক্তির প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ মনে করছে, তাদের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
তবে একদিকে গ্রেফতারের আতঙ্ক, অন্যদিকে, রাজনীতির মাঠের এখনকার নিয়ন্ত্রক দলগুলোর আক্রমণের ভয়–– এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বিশ্বাস করেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হয়েছে। দেশের অন্তত পাঁচটি জেলার বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে চায়। সেজন্যই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ওপর জোর দিচ্ছে। তা নাহলে ভুল স্বীকার করা হবে এবং তখন বিপর্যস্ত দলের নেতা-কর্মীদের হতাশা বাড়বে। যা দলটিকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও সমস্যা আরও বাড়াতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভুল স্বীকারের নজির সেভাবে নেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামী অন্তত দশ জন নেতার বিচার হয়েছে।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য জামায়াত দুঃখ প্রকাশ করেনি বা ক্ষমা চায়নি। এ বিষয়টি বিভিন্ন সময় উদাহরণ হিসেবে আলোচনায় আসে। আওয়ামী লীগও এটিকে উদাহরণ হিসেবে দেখাতে চায়।
দেশের ভেতরে রাজনীতির সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থানে ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগও কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করবে না বলে দলটির একাধিক নেতা বলেছেন। তারা মনে করেন, এখন অনুশোচনা প্রকাশ করা হলে তাদের নেতাকর্মীদের মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
যদিও এর নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, তাদের শাসনের পতনের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দমননীতি চালানো ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকা দলের নেতাদের মধ্যে পর্যালোচনা হয়েছে।
সেই আন্দোলন সামলাতে সে সময় রাজনৈতিক দিক থেকেও দলটির সরকার একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে, এমন আলোচনাও তাদের ভেতরে হয়েছে। কিন্তু সেই ভুল প্রকাশ্যে স্বীকার করার চিন্তা এখনো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের নেই।
তবে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ওপর ভর করে এবং কোনো অনুশোচনা না দেখিয়ে আওয়ামী লীগ মানুষের আস্থা ফেরাতে পারবে না।
তিনি বলেন, বাস্তবতা বিবেচনা নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশল ঠিক করা প্রয়োজন।
নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা
গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে এই বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন দলের নিবন্ধন স্থগিত করেছে এবং নৌকা প্রতীক বাদ দেওয়া হয়েছে।
সাবেক সচিব ও বিশ্লেষক আবু আলম শহীদ খান মনে করেন, সরকার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে না, এটা স্পষ্ট। দলটির নেতারা মনে করেন, সরকারের বাধা ছাড়াও আওয়ামী লীগের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলে অন্য দলগুলোও আক্রমণ বা বাধার সৃষ্টি করতে পারে।
সরকার ও এখানকার সক্রিয় দলগুলো আওয়ামী লীগ, এর মিত্র দলগুলোকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে দলটির অভিযোগ। সে কারণে দলটি আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করবে।
আবু আলম শহীদ খান বলছেন,আওয়ামী লীগের ব্যাপারে মানুষের মনে ক্ষোভ আছে, প্রশ্ন আছে। সে বিষয় বিবেচনায় অবস্থান স্পষ্ট না করলে দলটির সহসাই রাজনীতিতে ফেরা বেশ কঠিন।
কিউএনবি/আয়শা/৭ আগস্ট ২০২৫/বিকাল ৪:৩৩