মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৩ পূর্বাহ্ন

বিভিন্ন ধর্মে সমকামিতা

শহিদ আহমেদ খান সাবের,সিলেট প্রতিনিধি।
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২৪
  • ২০২ Time View

শহিদ আহমেদ খান সাবের,সিলেট প্রতিনিধি : প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ধর্মে মানবীয় নৈতিকতার বিচারে সমকামিতা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।যেখানে আব্রাহামিক ধর্মে সমকামিতাকে যৌনবিকৃতি হিসেবে নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অপরদিকে ভারতীয় ধর্মসমূহে সমকামীর প্রতি উদারতা এবং অনেক ক্ষেত্রে মান্যতা দেখা যায়।আরো বেশ কিছু ধর্মে বিপরীতকামিতার মত সমকামিতাকেও স্বাভাবিক বা দ্ব্যর্থক এবং উপরন্তুভাবে প্রাচীন পান্ডুলিপিতে এবং সাম্প্রতিককালের সংষ্কারবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে কিছু ধর্মে ইতিবাচকভাবেও একে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে সাম্প্রতিককালের দশকগুলোতে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে রক্ষণশীল সমকামিতা-বিরোধী আন্দোলন এবং সংষ্কারবাদী সমকামিতা-সমর্থন উভয় প্রকার আন্দোলন লক্ষ করা গেছে। ২০০৬ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে সমকামীতার বিপক্ষে রক্ষণশীল খ্রিষ্টানরা আন্দোলন করছে ইসলামে সমলিঙ্গীয় যৌনতা নিষিদ্ধ। কুরআন ও হাদীসে পূর্ববর্তী ইব্রাহিমীয় ধর্মের মতই কওমে লুতের সমকামিতা ও পুংমৈথুনের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে যেখানে সমকামিতা ত্যাগ না করার চূড়ান্ত পরিণতিতে শাস্তি হিসেবে ঐশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে তাদের ধ্বংস হওয়ার কথাও উঠে এসেছে। এছাড়া হাদীসে সডোমি অর্থাৎ পুংমৈথুনকারী বা পুংপায়ুকামী ও সমকামী ব্যক্তিদেরকে হত্যা করার নির্দেশ এসেছে।

কুরআনে সমকামিতাকে সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ বলা হয়েছে। এর জন্য শাস্তি প্রদেয় হবার ঘটনা উল্লেখ করে সবাইকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে- “এবং আমি লূতকে প্রেরণ করেছি। যখন সে স্বীয় সম্প্রদায়কে বললঃ তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের পূর্বে সারা বিশ্বের কেউ করেনি ? তোমরা তো কামবশতঃ পুরুষদের কাছে গমন কর নারীদেরকে ছেড়ে। বরং তোমরা সীমা অতিক্রম করেছ। তাঁর সম্প্রদায় এ ছাড়া কোন উত্তর দিল না যে, বের করে দাও এদেরকে শহর থেকে। এরা খুব সাধু থাকতে চায়। অতঃপর আমি তাকে ও তাঁর পরিবার পরিজনকে বাঁচিয়ে দিলাম, কিন্তু তার স্ত্রী।

সে তাদের মধ্যেই রয়ে গেল, যারা রয়ে গিয়েছিল। আমি তাদের উপর প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। অতএব, দেখ গোনাহগারদের পরিণতি কেমন হয়েছে।”- সূরা আ’রাফ ৮০-৮৪ এই জাতির মধ্যে সমকামীতা বৃদ্ধি পাবে এমন ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন নবী মুহাম্মদ সা, তিনি বলেছেন, “আমার উম্মতের উপর সমকামেরই বেশি আশঙ্কা করছি।”- তিরমিযী ১৪৫৭; ইবনে মাজাহ্ ২৬১১; মুসনাদে আহমাদ ২/৩৮২ সহীহুৎ-তারগীবি ওয়াৎ-তারহীব, হাদীস ২৪১৭ এছাড়াও হাদিসে সমকামী ব্যক্তিদেরকে অভিসম্পাত করছেন রাসূল সা: এমনকি স্বয়ং আল্লাহও লা’নত করেছেন।

আবু মুসা আল আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সা: বলেছেন, “যদি কোন মহিলার উপর কোন মহিলার উপবিষ্ট হয়, তবে তারা উভয়ই ব্যভিচারীনী, যদি কোনও পুরুষ কোন পুরুষের উপরে উপবিষ্ট হয় তবে তারা উভয়ই ব্যভিচারী।”  তাবারানী (আল-মু‘জামুল আওসাত): ৪১৫৭, বায়হাকী; শু‘আবুল ঈমান: ৫০৭৫ হাদিস ও ফিকহে সমকামিতার শাস্তি মৃত্যুদন্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোন পদ্ধতিতে তা কার্যকর করা হবে সেটার বিভিন্ন মত পাওয়া যায়।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন: মুহাম্মদ সা: বলেছেন, “যদি লূতের সম্প্রদায়ের কর্মে লিপ্ত কাওকে খুঁজে পাও, হত্যা কর তাকে যে এটি করে, এবং তাকে যার সাথে এটি করা হয়।- সুনান আবু দাউদ, ৩৮:৪৪৪৭ (ইংরেজি), তিরমিযী, ১৫: ১৪৫৬, ইবনে মাজাহ, ২০: ২৫৬১। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, মুহাম্মদ সাঃ বলেছেন, “অবিবাহিত পুরুষ যদি লিওয়াত/সডোমিতে (পায়ুমৈথুনে/পুংমৈথুনে) লিপ্ত অবস্থায় ধরা পড়ে, তাকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হবে।”-  সুনান আবু দাউদ, ৩৮:৪৪৪৮ (ইংরেজি) ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মে সমকামিতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আল্লাহর ক্রোধ ও গযবের কারণ।

বাইবেলের ভাষ্য হল, মানুষ সমকামী হয়ে সৃষ্টি হয়নি, বরং পাপের কারণে সমকামী হয়। বলা হয়েছে- “সেই কারণে ঈশ্বর, অশুদ্ধ যৌনাচারের প্রতি তাদের হৃদয়কে পাপপূর্ণ অভিলাষে সমর্পণ করলেন, যেন পরস্পরের দ্বারা তাদের শরীরের মর্যাদাহানি হয়। তারা ঈশ্বর-বিষয়ক সত্যের পরিবর্তে এক মিথ্যাকে মনোনীত করেছিল। তারা স্রষ্টার উপাসনা না করে সৃষ্ট বস্তুর উপাসনা ও সেবা করেছে—সেই স্রষ্টাই চিরতরে প্রশংসিত হোন। আমেন। এই কারণে, ঈশ্বর তাদের লজ্জাজনক রিপুর অধীনে সমর্পণ করেছেন।

এমনকি, তাদের নারীরাও স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্ক পরিবর্তন করে অস্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। একইভাবে, পুরুষেরাও নারীদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক ত্যাগ করে পরস্পরের প্রতি কামানলে প্রজ্বলিত হয়েছে। পুরুষেরা অন্য পুরুষদের সঙ্গে অশালীন কর্ম করেছে এবং তাদের বিকৃত আচরণের জন্য তারা যোগ্য শাস্তি লাভ করেছে।”-  রোমীয় ১:২৪-২৭ বাইবেলে আরোও বলা হয়েছে যে, সমকামিরা আল্লাহর রাজ্যে অধিকার লাভ করবে না।

ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিশ্বাস জর্ডানের একটি পাহাড়ে একটি মূর্তি রয়েছে যা লুত (আঃ) এর স্ত্রীর। সমকামিতার শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তায়ালা যখন কওমে লুতের উপর পাথুরে বৃষ্টির আযাব প্রেরণ করেন, নির্দেশ অমান্য করে লুত (আঃ) এর স্ত্রী ‘ওয়াইলা’ সহমর্মিতার চোখে পেছনের দিকে তাকায় ও তাদের কান্না হা-হুতাশ দেখে। সেজন্য তাকেও আল্লাহর আযাব গ্রাস করে নেয় ও মুর্তিতে পরিণত হয়! সে নিজে সমকামী না হলেও অন্যদের সমকামিতাকে সমর্থন করতো। তাই ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মে সমকামিতা শুধু অবৈধই নয়,বরং আল্লাহর গযব ক্রোধ ও শাস্তির কারণ। বাইবেলে পাওয়া যায় সমকামিতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

হিন্দু ধর্মের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব নেই। বহু হিন্দু সম্প্রদায় সমকামিতার বিষয়ে বিভিন্ন অবস্থান নিয়েছে, ইতিবাচক থেকে নিরপেক্ষ বা বৈরিতা পর্যন্ত। হিন্দুধর্মগ্রন্থ মনুস্মৃতিতে সমকামিতার শাস্তির বিধান পাওয়া যায়। নারী সমকামিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে- “যদি দু’কুমারীর মধ্যে সমকামিতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাহলে তাদের শাস্তি ছিলো দু’শত মূদ্রা জরিমানা এবং দশটি বেত্রাঘাত।”আরোও বলা হয়েছে- “যদি কোন বয়স্কা নারী অপেক্ষাকৃত কম বয়সী নারীর (কুমারীর)সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে,তাহলে বয়স্কা নারীর মস্তক মু-ন করে দুটি আঙুল কেটে গাধার পিঠে চড়িয়ে ঘোরানো হবে।”পুরুষ সমকামিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে- “দু’জন পুরুষ অপ্রাকৃতিক কার্যে প্রবৃত্ত হলে তাদেরকে জাতিচ্যুত করা হবে এবং জামা পরে তাকে জলে ডুব দিতে হবে।”

বৈদিক কাল থেকেই হিন্দুধর্মের মধ্যে একটি “তৃতীয় লিঙ্গ” স্বীকৃত। “মনু স্মৃতি” এবং “সুশ্রুত সংহিতা”র মতো বেশ কয়েকটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ দৃঢ়ভাবে বলে যে কিছু মানুষ প্রাকৃতিক জীববিজ্ঞানের বিষয় হিসাবে মিশ্রিত পুরুষ এবং স্ত্রী স্বভাব বা যৌন নিপীড়িত দ্বারা জন্মগ্রহণ করে। এছাড়াও, প্রতিটি হিন্দু সম্প্রদায়ের যৌনতা সম্পর্কিত স্বতন্ত্র বিধি তৈরি হয়েছিল, কারণ হিন্দু ধর্ম একীভূত নয় এবং মূলত বিকেন্দ্রীভূত। হিন্দু ধর্মগ্রন্থের কিছু তত্ত্বগুলি তৃতীয় লিঙ্গযুক্ত ব্যক্তিকে অত্যন্ত সম্মান করা হয়। সমকামীতার বিষয়টি নিয়ে হিন্দু গোষ্ঠীগুলি ঐতিহাসিকভাবে একীভূত নয়, প্রত্যেকেরই আলাদা মতবাদের মতামত রয়েছে।

খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ এর আশেপাশে রচিত ভারতীয় ‘কামসূত্র’ নামক গ্রন্থে নপুংসক বা “তৃতীয় লিঙ্গের” পুরুষদের সাথে ওরাল সেক্স করছে এমন পুরুষদের নিয়ে বর্ণনা করে এমন প্যাসেজও রয়েছে। পাঠ্যটি কামকে/ যৌনতাকে জীবনের তিনটি লক্ষ্য অর্জনের একটি হিসাবে বর্ণনা করেছে। যদিও এটি শিক্ষিত ব্রাহ্মণ, আমলা এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে অপরিষ্টক (ওরাল সেক্স) অনুশীলন করতে নিষেধ করেছে। একইভাবে, কিছু মধ্যযুগীয় হিন্দু মন্দির এবং নিদর্শনগুলি খোদুরাহোতে মন্দিরের দেয়ালের মতো তাদের খোদাইয়ের মধ্যে পুরুষ সমকামিতা এবং লেসবিয়ানিজম উভয়েরই প্রকাশ্যে চিত্রিত করে। এই চিত্রগুলি থেকে কিছু অনুমান করা যায় যে হিন্দু সমাজ এবং ধর্মের কমপক্ষে কিছু অংশ আগে বর্তমানে যৌন যৌনতার বিভিন্নতার জন্য আরও বেশি উন্মুক্ত ছিল।

অয়নি লিঙ্গ, যার মধ্যে ওরাল এবং পায়ূ সেক্স অন্তর্ভুক্ত, খ্রিস্টান ধর্মের মতো পাপ এবং গুরুতর অপরাধ হিসাবে কখনও দেখা যায় নি এবং কিছু ক্ষেত্রে এটি অনুশীলনও করা যেতে পারে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে একই লিঙ্গগুলির লোকদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বকেও জায়েজ হিসাবে দেখা গেছে। কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের (বিশেষত হিজড়াদের মধ্যে) অনেকগুলি রহশ্বরিকতা অহংকারী। সেখানে হিন্দু দেব-দেবীরা আছেন যারা আন্তঃআরক্ষ (উভয় পুরুষ ও মহিলা); যিনি তিনটি লিঙ্গই প্রকাশ করেন; যারা পুরুষ থেকে মহিলা বা মহিলা থেকে পুরুষে পরিবর্তিত হয়; মহিলা মেজাজ সহ পুরুষদেবতা এবং পুরুষ মেজাজ সহ মহিলা দেবতা; দুই পুরুষ থেকে বা দুটি স্ত্রীলোক থেকে জন্মগ্রহণকারী দেবদেবীরা; একক পুরুষ বা একক মহিলা থেকে জন্ম নেওয়া দেবতা; দেবতারা যারা বিপরীত লিঙ্গ এড়ান; একই লিঙ্গের প্রধান সহযোগীদের সাথে দেবতারা, এবং আরও।

বেশ কয়েকটি হিন্দু পুরোহিত সমকামী বিবাহ করেছিলেন, এই যুক্তি দিয়ে যে প্রেম পূর্বের জন্মের সংযুক্তির ফল এবং এই বিবাহকে চেতনার মিলন হিসাবে লিঙ্গের থেকেও বহির্ভূত আধুনিক হিন্দু সংস্কৃতিতে “হোমোফোবিয়া” মূলত উপপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রণীত সমকামিতা বিরোধী আইনের ফলাফল। কিন্তু পৌরাণিক ইতিহাসে কামক্রিয়ার অস্বাভাবিকতার উপস্থিতি প্রচ্ছন্নভাবে দেখা যায় যাতে বিভিন্ন সময় সমকামীতার মতো বা সাদৃশ্য যৌনাবৃত্তিক বর্ণনা থাকে।
লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, সদর, সিলেট-৩১০০, মোবাঃ ০১৭০৪০৮১৪০৬

 

কিউএনবি/আয়শা/১১ জানুয়ারী ২০২৪,/রাত ৯:৫০

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

September 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit