স্পোর্টস ডেস্ক : হাসপাতালের ঔষধালয়ে কাজ করতেন বাবা। ছিলেন খুবই ধার্মিক, যিনি চাইতেন না ক্রিকেট খেলে সময় নষ্ট করুক ছেলে। কিন্তু মোহাম্মদ রিজওয়ান তো হাল ছাড়ার পাত্র নন। ক্রিকেটার যে তাকে হতেই হবে। বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে খেলে বেড়াতেন নানা জায়গায়। কঠিন সব বাধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত পূরণ করেছেন ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। শৈশব থেকেই রিজওয়ানের মধ্যে ছিল হার না মানা মানসিকতা। ২২ গজেও তিনি ঠিক তেমন। সহজে হাল ছেড়ে দেন না, লড়াই চালিয়ে যান শেষ অবধি। পাকিস্তান কিপার-ব্যাটসম্যানের দৃঢ়তায় মুগ্ধ হয়ে ভারতীয় সাবেক ক্রিকেটার আকাশ চোপড়া একবার বলেছিলেন ‘হি ইস অ্যা ওয়ারিয়র।’
রিজওয়ানের ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে কথাটির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করার উপায় নেই। ক্রিকেট আঙিনায় মসৃণ ছিল না তার পথচলা। এই খেলার হাতেখড়ি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সীমানায় পা দেওয়া পর্যন্ত অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। জাতীয় দলে এসে শুরুতে তো পায়ের নিচের মাটিই খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন বাদ পড়ার দুয়ারেও। ২০১৯ বিশ্বকাপের দলে জায়গা না পেয়ে বেশ কষ্ট পাওয়া রিজওয়ান কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি। কঠোর পরিশ্রম করে, নিজেকে ভেঙে গড়ে আজ পাকিস্তানের রঙিন পোশাকের দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ তিনি। দলটির ব্যাটিং লাইনআপের বড় ভরসা।
বিশ্বকাপেও নিজের সামর্থ্যরে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন রিজওয়ান। দুর্দান্ত ধারাবাহিকতায় একের পর এক ম্যাচে করছেন রান। এখন পর্যন্ত আসরে তার ব্যাট থেকে এসেছে ২৪৮ রান, ব্যাটিং গড় আকাশচুম্বী ১২৪! তিন ম্যাচে একটি করে সেঞ্চুরি ও ফিফটি পেয়েছেন। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৬৮ রানের ইনিংস খেলে শুরু করেন বৈশ্বিক আসর। পরের ম্যাচে ছাড়িয়ে যান নিজেকে। খেলেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস, ১২১ বলে অপরাজিত ১৩১। তার ইনিংসের সৌজন্যে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বিশ্বকাপে রান তাড়ার রেকর্ড গড়ে জেতে পাকিস্তান। চোট নিয়ে ওই ইনিংসটি খেলেন রিজওয়ান, যা তার লড়াকু মানসিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে সবশেষ লড়াইয়ে ১ রানের জন্য ফিফটি ছুঁতে পারেননি ৩১ বছর বয়সী ক্রিকেটার।
বিশ্বকাপে প্রতিপক্ষের জন্য যে রিজওয়ান বড় হুমকি হবেন সেটার আভাস আগে থেকেই ছিল তার ব্যাটে। ওয়ানডেতে সবশেষ ১০ ইনিংসে চার ফিফটি ও এক সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। আর দুইবার গিয়েছেন চল্লিশের ঘরে। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১০১ রানের ইনিংস। তাসমান সাগর পাড়ের আরেক দল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আজ লড়াই পাকিস্তানের। বেঙ্গালুরুতে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের কাছে থেকে আরেকটি ভালো ইনিংসের প্রত্যাশা করবে পাকিস্তান। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে রিজওয়ানের পারফরম্যান্স অবশ্য আহামরি নয়। এখন পর্যন্ত ১৩ ওয়ানডেতে ৩৫ গড়ে করেছেন ৩১৫ রান। যদিও তার দুই ওয়ানডে সেঞ্চুরির দুটিই এসেছে এই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
রিজওয়ানকে থামানোর অস্ত্র অবশ্য অস্ট্রেলিয়া দলে আছে। এই পাকিস্তানি ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশিবার যে তিন বোলারের বিপক্ষে আউট হয়েছেন তার দুজনই অস্ট্রেলিয়ার লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা ও পেসার প্যাট কামিন্স। আর দুজনই চলতি বিশ্বকাপে খেলছেন। রিজওয়ানকে তিনবার আউট করতে ১৪ ম্যাচ লেগেছে জাম্পার। কামিন্সের সেখানে লেগেছে মাত্র ৬ ম্যাচ। তাই দলীয় লড়াইয়ের ভেতরে আজ দেখা যেতে পারে রিজওয়ান-কামিন্সের লড়াইও। সফল হবেন কে? উত্তর মিলবে ম্যাচ শেষে।
শুধু চমৎকার ফর্মে থাকা রিজওয়ানকে থামালেই চলবে না কামিন্সকে। পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপকে অল্পতে আটকে রাখতে সতীর্থদের সঙ্গে বল হাতে ভূমিকা রাখতে হবে তাকেও। আর দলের অধিনায়ক তিনি। দুর্দান্ত বোলিংয়ের সঙ্গে তার কাছ থেকে ক্ষুরধার নেতৃত্বের আশা করবে অস্ট্রেলিয়ানরা। গত বছর অ্যারন ফিঞ্চ ওয়ানডে থেকে অবসর নেওয়ার পর দায়িত্বটি পেয়েছিলেন তিনি। এখন পর্যন্ত তার নেতৃত্বে ৭ ওয়ানডেতে খেলে চারটি জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। তবে বিশ্বকাপের শুরুতে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হেরে সমালোচনার মুখেও পড়েছিলেন কামিন্স। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সেই চাপ থেকে কিছুটা মুক্তি মিলেছে তার।
বল হাতে বিশ্বকাপে এখনো নি®প্রভই বলা যায় কামিন্সকে। তিন ম্যাচে তার শিকার তিনটি। তবে ছন্দে ফেরার আভাস মিলছে তার বোলিংয়ে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সবশেষ ম্যাচে ২ উইকেট নিয়েছেন তিনি ৩২ রান দিয়ে। এমনিতে ওয়ানডেতে পরিসংখ্যান খারাপ নয় কামিন্সের, ৮০ ম্যাচে উইকেট ১২৯টি। কিন্তু ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করতে না পারায় মাঝেমধ্যেই এই সংস্করণে তার কার্যকারিতা নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। পাকিস্তানের বিপক্ষে বল হাতে বেশ উজ্জ্বল ৩০ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। ৭ ওয়ানডেতে ১৩ উইকেট নিয়েছেন ওভারপ্রতি সাড়ে চারের নিচে রান দিয়ে।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ভালো করতে কামিন্সকে আত্মবিশ্বাস জোগাতে পারে ভারতের কন্ডিশন সম্পর্কে তার জ্ঞান। দেশটিতে ১৮ ওয়ানডে খেলে ২৫ উইকেট নিয়েছেন এই পেসার। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তার একমাত্র পাঁচ উইকেটের কীর্তি ভারতের মাটিতেই, ২০১৯ সালে মোহালিতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে। এছাড়া ২০১৪ সাল থেকে আইপিএল খেলেছেন কামিন্স। ভারতের ঘরোয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে ৪২ ম্যাচে তার শিকার ৪৫ উইকেট। তাই পরিচিত কন্ডিশনের সুবিধা তো কাজে লাগাতেই পারেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক। আর বিশ্বকাপেও খারাপ নয় তার পারফরম্যান্স। এখন পর্যন্ত ১৫ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ২২ উইকেট। বৈশ্বিক আসরে খেলার অভিজ্ঞতাও কাজে লাগাতে পারেন ২০১৫ শিরোপাজয়ী দলের সদস্য।
প্যাট কামিন্স পেসার
এক যুগের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৮০ ম্যাচে নিয়েছেন ১২৯ উইকেট। ছয়বার পেয়েছেন চার উইকেট, পাঁচ উইকেট একবার। এ নিয়ে তৃতীয়বার খেলছেন ওয়ানডে বিশ্বকাপে।
মোহাম্মদ রিজওয়ান ব্যাটসম্যান
৮ বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৬৮ ম্যাচে রান ১৯৪১। ব্যাটিং গড় ৪০.৪৩, স্ট্রাইক রেট ৮৯.২০। সেঞ্চুরি আছে তিনটি, ফিফটি ১৩টি। প্রথমবার খেলছেন ওয়ানডে বিশ্বকাপে
কিউএনবি/আয়শা/২০ অক্টোবর ২০২৩,/বিকাল ৩:৪৫