রুমকীর মন খারাপ। তিনদিন যাবৎ তার মন খারাপ। তার এই মন খারাপের অনেক কারণের মধ্যে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যু অন্যতম। রুমকী ভাবছে, তাঁর এই মৃত্যুটা স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি অসুস্থ। করোনাকালীন সময়ে একাধিকবার তিনি ইনফেক্টেড হয়েছিলেন। তখন থেকেই তাঁর শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা। কিডনি ডায়ালাইসিস করে তিনি তাঁর সময়গুলো অতিবাহিত করেছিলেন। শেষে আর পেরে উঠলেন না। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে ।
এখন বাংলাদেশে রাত দশটা । ইতঃস্ততা করেই রুমকী কল দিল নাহিদকে। ইতঃস্ততার কারণ নাহিদ কি তারাবীহ নামাজ শেষ করেছে ? হোয়াটস্যাপে প্রথম কলেই নাহিদ ফোন রিসিভ করল। ইতঃস্ততার ক্লেশ নিমিষেই উধাও হলো রুমকীর ভাবনা থেকে। নাহিদটা কি ভাল ? প্রথমেই রুমকী জানতে চাইল, তুমি কি বাসায় ? নাহিদ জবাব দিল, নাহঃ এখনো বাসায় যাইনি। তারাবীহ শেষ করে কয়েকজন মুসল্লি সহ চা খাচ্ছি মসজিদের সামনের দোকানে ? সমস্যা নেই, তুমি বলো, আমি আলাদা হচ্ছি।
কি বলব ? মনটা খারাপ তুমি জানো। অনেক কারণের মধ্যে ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। বেচারার দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল। অনেক ভাল কিছু দেখে যাওয়ার অপূর্ন ইচ্ছার মাঝেই তিনি চলে গেলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথা গুলো বলল রুমকী। নাহিদ পাল্টা জবাব দিল, মন খারাপ শুধু তোমার নয়। মন খারাবীটা পুরো বাংলাদেশের। তুমি যদি পুরো বাংলাদেশের চিত্রটা দেখতে? সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের মুখে শুধু ডাঃ জাফরুল্লাহর নাম। সোশ্যাল মিডিয়া, প্রিন্ট ,ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া কোথায় নাই তিনি ? বাংলাদেশে ১০ কোটি মানুষ যদি ফেসবুক চালায়, তাহলে তার অর্ধেকই ডাঃ জাফরুল্লাহর জন্যে মাতম করেছে। শোক প্রকাশ করেছে। অবিরত দোয়া করছে। রুমকী, ডাঃ জাফরুল্লার চিরবিদায় এক গৌরবময় বিদায়। এত মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা পাওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার।
রুমকী নাহিদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, আমিতো তাই বলতে চাচ্ছি। আমরা মৃত কারও প্রশংসা অকুন্ঠ চিত্তে করে থাকি। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে চাইনা। বরং তাঁদের অপমান করা আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এই যে আমরা ডাঃ জাফরুল্লাহকে নিয়ে এখন হায় মাতম করছি, কোথায় সেদিন ছিল এই মানুষেরা ? কোথায় ছিল এত শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ? নাহিদ জিজ্ঞাসা করল রুমকীকে, তুমি কিসের কথা বলতে চাচ্ছ ? রুমকী সরাসরি জবাব দিল, জীবিত জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে চুরির মামলার কথা। রুমকী শুরু করল, সেই মামলার কাহিনী।
সাভারের আশুলিয়ায় কানাডিয়ান কলেজে ভাঙচুর ও মালামাল চুরির অভিযোগে মোহাম্মদ আলী নামে এক ব্যক্তি ২০১৯ সালের ১২ জুলাই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ ১৬ জনের নামে আশুলিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, বাদী মোহাম্মদ আলী ও তার কয়েকজন বন্ধু মিলে আশুলিয়া থানাধীন পাখালিয়ায় ৪ দশমিক ২৪ একর সম্পত্তি ক্রয় করে চারপাশে পাকা বাউন্ডারি ওয়াল ও গেট নির্মাণ করে ভোগদখল করে আসছিলেন। তারা ওই জমিতে কানাডিয়ান কলেজ প্রতিষ্ঠা করে তা পরিচালনা করছিলেন। সেখানে তাদের কলেজের আরও একটি ভবন নির্মাণকাজ চলছিল। মামলার আসামি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাদের সম্পত্তি অবৈধভাবে দখলের উদ্দেশ্যে পাঁয়তারাসহ বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছিলেন।
এজাহারে আরও অভিযোগ করা হয়, ২০১৯ সালের ১০ জুলাই মামলার এজাহারনামীয় আসামিরা ভেকু নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। বাদীর সম্পত্তির মূল গেট ও বাউন্ডারি ওয়াল ভাঙচুর করে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করে সেখানে থাকা নিরাপত্তারক্ষীদের এলোপাতাড়ি মারপিট করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করেন। এছাড়া আসামিরা বাদীর কলেজের অফিসকক্ষে থাকা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ভাঙচুর করেন। অফিসে থাকা তিনটি কম্পিউটার, ৮২টি চেয়ার, ২৮টি সিলিংফ্যান, তিনটি ফায়ার এক্সিট ডিভাইস চুরি করে ট্রাকযোগে নিয়ে যান। যার মোট মূল্য তিন লাখ ৯ হাজার ১০০ টাকা। এছাড়া আসামিরা পালিয়ে যাওয়ার সময় কলেজের আলমারি ভেঙে শিক্ষার্থীদের মূল সনদপত্রসহ অন্যান্য মূল্যবান কাগজপত্র লুট করে নিয়ে যান।
এই মামলা বিষয়ে রুমকীর বয়ানে নাহিদ বাঁধা দিয়ে বলল, চার্জশিটে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক সাইফুল ইসলাম শিশিরসহ ১৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। চার্জশিটের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেছিলেন মামলার বাদী মোহাম্মদ আলী। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হারুন অর রশিদ। তিনি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। রুমকী জবাবে বলল, অব্যাহতি দান বড় কথা নয় ? ডাঃ জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেউ বিশ্বাস করবে? এই মামলাতো গ্রহণ করাই উচিত হয়নি।
নাহিদ এবার বলল,২০১৮ সালের অক্টোবরে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় মাছ ও ফল চুরির একটি মামলা। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে চাঁদা দাবি,মারধর ও জমি দখলের চেষ্টার অভিযোগও আনা হয়। ঢাকার আশুলিয়া থানায় ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা কাজী মহিবুর রব বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক সাইফুল ইসলামসহ অন্তত: ৩০ জনকে আসামি করা হয়।
২০১৮ সালের ১৫,১৯,২১ ও ২৩ অক্টোবর ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগে পৃথক ৪টি মামলা হয়। ওইবছর ১৫ অক্টোবর একটি মামলা করেন মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার মোহাম্মদ আলী ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের আনিছুর রহমান। মামলায় ডা: জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে জমি দখলের চেষ্টা, চুরি, ভাঙচুর ও চাঁদা দাবির অভিযোগ আনেন। ১৯ অক্টোবর আশুলিয়ার ডেন্ডাবর এলাকার ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলামের পক্ষে মামলা করেন কেয়ারটেকার হাসান ইমাম। এ মামলায় জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে ভাঙচুর, চাঁদা দাবি ও জমি দখলের চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। এ দুই মামলায় জামিন লাভের দিন দিবাগত রাতে তার বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সৈয়দ সেলিম আহম্মেদ। বলাবাহুল্য, এ সময় ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ক্ষমতাসীন সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও আচরণ নিয়ে সমালোচনায় ছিলেন মুুখর।
রুমকী এবার উপসংহার টানবে বলে জানাল নাহিদকে। উপসংহার শুনেই নাহিদ বাসায় ফিরবে, জানাল রুমকীকে। বলতে শুরু করল রুমকী। আমি আর মামলার প্রসঙ্গ টানলাম না। গত দেড় দশকে তাকে একাধিকবার দাঁড়াতে হয়েছে আসামির কাঠগড়ায়। একবার আদালত তাঁকে বয়স বিবেচনায় কাঠগড়ায় একঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার দন্ড প্রদান করেছিল। সারাটি জীবন মানুষের জন্য বিলিয়ে দেয়া জনদরদী ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বার বার দাঁড় করানো হয়েছে আসামির কাঠগড়ায়। মরণোত্তর দেহদানকারী নির্লোভ এই মানুষটিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে হাস্যকর অভিযোগে। স্পষ্টবাদীতার কারণে তাকে হতে হয়েছে দোষী।
ডাঃ জাফরুল্লাহর ইন্তেকালে এখন অনেকে শোকবাণী দিলেও জীবদ্দশায় পদে পদে তাঁকে করা হয়েছে অপদস্ত। রুদ্ররোষে পড়েছিলেন শাসক শ্রেণিরও। একের পর এক তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে মিথ্যা মামলা। নাহিদ, প্রকৃতি অস্বাভাবিকতা গ্রহণ করেনা। আজ ডাঃ জাফরুল্লাহ মৃত, আজ আমরা তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে স্তুতি বাক্য প্রয়োগে মুখের ফেনা তুলছি, কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায়,তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করিনি, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা চুপ করেছিলাম। এ নিয়ে এখন যদিও আমরা অনুশোচনা করি, প্রকৃতি কি আমাদেরকে ক্ষমা করবে ?
– লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও লেখক।
সূত্রঃ ১.জনকণ্ঠে প্রকাশিত: ২০:০২, ১৩ জানুয়ারি ২০২১ এর সংবাদ।
২. দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত সাঈদ আহমেদ এত গত ১২ এপ্রিল ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের প্রতিবেদন সংবাদ।