রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০২ পূর্বাহ্ন

আপন ভাতিজার হাতেই খুন কুষ্টিয়ার সেই স্কুলশিক্ষিকা

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ৮ নভেম্বর, ২০২২
  • ১৬৬ Time View

ডেস্ক নিউজ : নিজ সন্তানের মত আদর-স্নেহ দিয়ে কোলে-পিঠে করে মানুষ করা আপন ভাতিজার হাতেই খুন হয়েছেন কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের সিনিয়র শিক্ষিকা রোকসানা খানম রুনা (৫২)। ভাতিজা নওরোজ কবির নিশাত (২০) একাই ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় শীল দিয়ে মাথায় পরপর দুটি আঘাত করে ফুফু রোকসানা খানম রুনাকে হত্যা করে। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ রহস্য উন্মোচন ও হত্যাকারীকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে।

স্কুলশিক্ষিকা রোকসানা খানম রুনার হত্যাকারী তার আপন ভাতিজা নওরোজ কবির নিশাত বলে নিশ্চিত করেছেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল আলম। তিনি জানান, মূলত নিশাত একজন মাদকাসক্ত। একই সাথে সে আইপিএলসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। 

সোমবার বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং ডি ব্লকের ২৮৫নং নিজ বাসার শয়নকক্ষের বিছানার ওপর থেকে রোকসানা খানম রুনার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের ইংরেজি বিষয়ের সিনিয়র শিক্ষিকা ছিলেন। তার স্বামী খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান শিশির যশোরের চৌগাছা এলজিইডি অফিসে কমিউনিটি অর্গানাইজার পদে চাকরি করেন। সপ্তাহান্তে তিনি কুষ্টিয়ায় আসতেন। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে হাউজিং ডি ব্লকে নিজের নামে ছয়তলা বিশিষ্ট ওই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন রোকসানা খানম। 

পুলিশ সুপার খাইরুল আলম জানান, হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের সবগুলো ইউনিটের প্রধানদের সমন্বয়ে পুলিশের একাধিক টিমকে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের জন্য মাঠে নামানো হয়। সোমবার দুপুর ২টার দিকে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই শিক্ষিকার আপন ভাতিজা নিশাতসহ ওই বাড়িতে ভাড়া থাকা আরও দুই যুবককে আটক করে নিয়ে আসে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে টানা প্রায় ৬ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর ভাতিজা নওরোজ কবির নিশাত অকপটে ফুফু রোকসানা খানম রুনাকে হত্যার কথা স্বীকার করে। ঘাতক নওরোজ কবির নিশাত স্কুলশিক্ষিকা রুনার আপন বড় ভাই মৃত একেএম নূরে আসলামের ছোট ছেলে।

ফুফু রোকসানা খানম রুনার ছয় তলা ওই বাড়ির চার তলার একটি ফ্ল্যাটে মা এবং বড় ভাইয়ের সাথে থাকত নিশাত। ২০১৩ সালে ভাইয়ের মৃত্যুর পর ভাইয়ের অসহায় পরিবারকে বিনা ভাড়ায় ওই বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন স্কুল শিক্ষিকা রুনা। দুই ভাইয়ের মধ্যে নিশাত ছোট। মা কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লারিক্যাল পোস্টে চাকরি করেন। বড় ভাই নির্ঝর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। 

কুষ্টিয়া সাইবার ক্রাইম ইউনিটের ইনচার্জ আনিসুল ইসলাম জানান, নিজের কোনও সন্তান না থাকায় ছোট বেলা থেকেই পরম আদর-স্নেহ দিয়ে কোলে পিঠে করে দুই ভাতিজা নিশাত এবং নির্ঝরকে বড় করেন ফুফু রোকসানা খানম। তবে ছোট হওয়ায় ভাতিজা নির্ঝরের চেয়ে নিশাতকেই বেশি আদর-স্নেহ করতেন। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর কারণে তার দুই ছেলে এবং ভাবীকে সব সময় আগলে রাখতেন তিনি। নিজ বাড়ির ৪র্থ তলার একটি ফ্ল্যাটে বিনা ভাড়ায় থাকতে দিয়েছিলেন। আদরের ভাতিজা নিশাতকে কিছু দিন আগে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে একটি বাইকও কিনে দেন।

জানা গেছে, নওরোজ কবির নিশাত গত বছর এইচএসসি পাস করে। কিন্তু কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় এ বছর পুনরায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রোকসানা খানম ভাতিজা নিশাতকে তার নিজের টাকা দিয়ে ছয় তলা ওই বাড়ির নিচে একটি মুদি খানার দোকানও করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে নিশাত গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। একই সাথে আইপিএলসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়া খেলায় আসক্ত হয়ে যায়। অনলাইন জুয়া খেলায় হেরে গিয়ে দেনা পরিশোধের জন্য ফুফুর দেওয়া মোটরসাকেল গত মাসে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়। এছাড়াও ছয় তলা ওই বাড়ির সব ফ্ল্যাটের ভাড়াও সে আদায় করত। 

ভাতিজা নওরোজ কবির নিশাতের এই উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন নিয়ে চরম বিরক্ত ছিলেন ফুফু স্কুলশিক্ষিকা রোকসানা। এ নিয়ে প্রায়ই তিনি ভাতিজা নিশাতকে বকাঝকা করতেন। সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের আগের দিনও এসব বিষয় নিয়ে নিশাতকে বকাঝকা করেন ফুফু রোকসানা। উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন নিয়ে প্রায়ই বকাঝকা করায় ফুফুর প্রতি চরম ক্ষোভ জন্মে মাদকাসক্ত নিশাতের। এ কারণে সে ফুফুকে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার ছক তৈরি করে। ঘটনার দিন স্কুলের কাজে যশোরে গিয়েছিলেন রোকসানা খানম। ছয় তলার ছাদে রোকসানা ছাগল, কবুতর, খরগোশসহ পশু-পাখি পালন করতেন। যশোর থেকে ফিরে রাত প্রায় ১১টার দিকে আরেক ভাতিজা নিশাতের বড় ভাই নির্ঝরকে সাথে নিয়ে ছাদে পশু-পাখি দেখতে যান। দোতলায় ফিরে এসে রোকসানা নিচে কলাপসিবল গেটে তালা লাগাতে যান। এই সুযোগে ভাতিজা নওরোজ কবির নিশাত ফুফুর রোকশানার ফ্ল্যাটের স্টোর রুমে লুকিয়ে পড়ে। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে রোকসানা ঘুমানোর জন্য বিছানায় যান। নিশাত অপেক্ষা করতে থাকে ফুফু কখন ঘুমাবে। ফুফু ঘুমিয়ে পড়লে এক পর্যায়ে রাত ১টা থেকে ১টা ২০ মিনিটের মধ্যে স্টোর রুমে থাকা শীল দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ফুফু রোকসানা খানমের মাথায় পর পর দুটি আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। 

হত্যাকাণ্ডের মোড় অন্যদিকে প্রভাবিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে সে প্রতিটি ঘরের আসবাব-পত্র কাপড় চোপড়, ড্রয়ার সব কিছু মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। একই সাথে রাত ১টা ৩৭ মিনিটের দিকে সে ফুফুর মোবাইল ফোন নিয়ে ফুফুর হোয়াস্ট আ্যাপ থেকে নিজেই তার হোয়াস্ট আ্যাপে ম্যাসেজ দিয়ে কথোপকোথন করে। যাতে ফুফু দু’জন ব্যক্তির কাছে পাওনা টাকা পেত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহের তীর যেন তাদের দিকে গিয়ে পড়ে। দুর্বৃত্তরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এসব আলামত সৃষ্টির জন্য ঘর-দুয়ার সব এলোমেলো করে রাখে। বারান্দার দরজায় দা দিয়ে কোপ মারে। এক পর্যায়ে সে বরান্দার গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে নিচে নেমে এসে হত্যাকাণ্ডের কাজে ব্যবহৃত শীলটি লিফট ঘরের মধ্যে রেখে দেয়। 

হত্যাকাণ্ডের পর রাত ২ টা ৪৫ মিনিটের দিকে নিশাত ওই বাড়িতে ভাড়া থাকা লিজান ও শাকিল নামের দুই যুবককে ডেকে তুলে শাকিলের ফ্ল্যাটে গিয়ে তিনজন মিলে একত্রে গাঁজা সেবন করে। গাঁজা সেবন শেষ হলে ঘরে ফিরে রাত ২ টা ৫৮ মিনিটের সময় শাকিলকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে কোনও শব্দ পেয়েছে কি না? শাকিল কোনও শব্দ শোনেনি বলে জানালে সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘটনার দিন সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো বাড়ির নিচে মুদি দোকান খুলে বেঁচা-বিক্রি শুরু করে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সে পার্শ্ববর্তী নিশান মোড়ে নাস্তা খেতে যায়। নাস্তা সেরে এসে সকাল ১০টার দিকে সে ফুফুর দরজা ধাক্কাতে থাকে। ফুফু দরজা না খোলায় অন্য ফ্লাটে থাকা ভাড়াটিয়াদের জানাই ফুফু দরজা খুলছে না। বিষয়টি সে মোবাইল ফোনে যশোরে থাকা ফুফুর স্বামী খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান শিশিরকে জানায়। পরবর্তীতে তার মোবাইল ফোন থেকে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ফোন করে বিষয়টি জানালে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে স্থানীয়দের সহযোগিতায় দরজা ভেঙে স্কুলশিক্ষিকা রোকসানা খানম রুনার রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে।

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম জানান, অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে নওরোজ কবির নিশাত একাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। নিশাতের দেওয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী নিশাতকে সাথে নিয়ে সোমবার রাত সাড়ে ১১ টার দিকে ওই বাড়ির লিফটের ঘর থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত শীলটি পুলিশ উদ্ধার করেছে। নিশাত নিজেই শীলটি পুলিশকে ওই ঘর থেকে বের করে দেয়। 

কুষ্টিয়া সাইবার ক্রাইম ইউনিটের ইনচার্জ আনিসুল ইসলাম আরও জানান, জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতেই মিথ্যা কথা বলে নানাভাবে পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে থাকে নিশাত। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় একের পর এক তথ্য উপস্থাপন করার এক পর্যায়ে টানা ৬ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর রাত ৮টার দিকে নওরোজ কবির নিশাত ফুফু রোকসানা খানম রুনাকে হত্যার কথা স্বীকার করে এবং হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেয়।

পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করার পর আটক অপর দুজনকে তাদের অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। 

এদিকে সোমবার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিহত স্কুলশিক্ষিকা রোকসানার লাশের ময়নাতদন্ত শেষে বিকালে তা পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাতে জানাজা শেষে ভেড়ামারায় নিজ গ্রামের গোরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়। 

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুষ্টিয়া মডেল থানার এসআই জহুরুল ইসলাম জানান, হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করায় আসামি নওরোজ কবির নিশাতকে মঙ্গলবার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করা হবে।

কিউএনবি/অনিমা/০৮.১১.২০২২/দুপুর ১২.৪৬

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit