রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৬ পূর্বাহ্ন

হাসিনা মঞ্জিল এর ফজিলাতুন্নেসা জোহা’ ও এক নিষিদ্ধ যুবকের ব্যর্থ প্রেম

Reporter Name
  • Update Time : শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২
  • ২০১৭ Time View

হাসিনা মঞ্জিল এর ফজিলাতুন্নেসা জোহা’ ও এক নিষিদ্ধ যুবকের ব্যর্থ প্রেম
==============================================

১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছিলো, একটা ছেলে যদি একজন মেয়ের সাথে কথা বলতে চায়, তবে তাকে প্রক্টর বরাবর দরখাস্ত দিতে হবে। শুধুমাত্র প্রক্টর অনুমতি দিলেই সে কথা বলতে পারবে প্রক্টরের বিধিমোতাবেক ব্যবস্থাপনায়। এছাড়া নয়। এমনকি ক্লাসের কোন মেয়ের সাথেও কেউ কথা বলতে পারবেনা।

১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র ৬ বছর পর। একদিন কোলকাতা থেকে একজন ঝাঁকড়া চুলের যুবক এলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখবেন। কয়েকজন বন্ধু বান্ধব নিয়ে সে ঘুরতে বের হলো। তখন কার্জন হল ছিলো বিজ্ঞান ভবন।ঘুরতে ঘুরতে যখন কার্জন হলের সামনে এসে পড়লো তারা, সে যুবক দেখলো দূরে একটা থ্রী কোয়ার্টার হাতার ব্লাউজ আর সুতির শাড়ি পরা এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলেন, এই মেয়েটি কে? তখন তার বন্ধুরা বলল, এ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম নারী ছাত্রী। তখন সেই যুবক বলে, সত্যি? আমি এই মেয়ের সাথে কথা বলব। তখন সে যুবক মেয়েটির সাথে কথা বলার জন্য একটু এগিয়ে গেলে তার বন্ধুরা তাকে বাঁধা দেয়। বলে, না তুমি যেওনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের সাথে কথা বলার অনুমতি নেই। তুমি যদি ওর সাথে অনুমতি ছাড়া কথা বলো তবে তোমার শাস্তি হবে।

সেই যুবক বলল, “আমি মানি নাকো কোন বাঁধা, মানি নাকো কোন আইন।”সেই যুবক হেঁটে হেঁটে গিয়ে সেই মেয়েটির সামনে দাঁড়ালো। তারপর তাকে বলল, আমি শুনেছি আপনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম নারী ছাত্রী। কি নাম আপনার? মেয়েটি মাথা নিচু করে বলল, ফজিলাতুন্নেছা। জিজ্ঞাসা করলো, কোন সাবজেক্টে পড়েন? বলল, গণিতে। গ্রামের বাড়ি কোথায়? টাঙ্গাইলের করটিয়া। ঢাকায় থাকছেন কোথায়? নাজিমুদ্দিন রোড। এবার যুবক বললেন, আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম নারী ছাত্রী, আপনার সাথে কথা বলে আমি খুব আপ্লুত হয়েছি।

আজই সন্ধ্যায় আমি আপনার সাথে দেখা করতে আসবো। মেয়েটি চলে গেলো। এই সব কিছু দূরে দাঁড়িয়ে এসিস্ট্যান্ট প্রক্টর স্যার দেখছিলেন। তার ঠিক তিনদিন পর। ২৯ ডিসেম্বর ১৯২৭, কলা ভবন আর বিজ্ঞান ভবনের নোটিশ বোর্ডে হাতে লেখা বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দেয়া হলো যুবকের নামে। তার নাম লেখা হলো, তার বাবার নাম লেখা হলো এবং বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো, এই যুবকের আজীবনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ।

তারপরে এই যুবক আর কোনদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেননি। সেইদিনের সেই যুবক, বৃদ্ধ বয়সে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করলেন। যে যুবক আর কোনদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ করেননি, তার মৃত্যুর পরে তার কবর হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন। সেই যুবকের নামঃ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মেয়েটি ফজিলাতুন্নেসা জোহা।

অনেকের মতে নজরুলের জীবনে প্রেম মূলত তিনবার এসেছিল। প্রথম প্রেম নার্গিস, দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমীলা দেবী এবং তৃতীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের প্রথম স্নাতকোত্তর মুসলমান ছাত্রী এবং সওগাত পত্রিকার একজন বিশিষ্ট লেখিকা ফজিলাতুন্নেসাকে ভালোবেসে ছিলেন নজরুল। ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির গভীর অনুরাগ যা একান্তই গোপন ছিল। নজরুলের এই প্রেমের কথা মাত্র দুজন জানতেন-কাজী মোতাহের হোসেন ও ফজিলতুন্নেসা নিজে। টাঙ্গাইলের সদর থানার নামদার কুমুল্লী গ্রামে জন্ম নেয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোক উদ্ভাসিত কারি, মহিয়সী নারী বেগম ফজিলতুন্নেসা জোহা।

বেগম ফজিলতুন্নেসা জোহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী ও ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন (১৯৪৮-৫৭)। তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্রী যিনি উচ্চ শিক্ষার্থে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যান। বেগম ফজিলতুন্নেসা সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায় কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে….

“বেগম ফজিলতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরীও ছিলেন না অথবা বীনানিন্দিত মঞ্জুভাষিণীও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম এ এবং একজন উচুঁদরের বাক্‌পটু মেয়ে ”জন্ম বেগম ফজিলতুন্নেসার জন্ম ১৮৯৯ সালে টাঙ্গাইল জেলার সদর থানার নামদার কুমুল্লী গ্রামে। পিতার নাম ওয়াজেদ আলী খাঁ, মাতা হালিমা খাতুন।। ওয়াজেদ আলী খাঁ মাইনর স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।

১৯২৭ সালে কাজী নজরুল ইসলাম বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমাজের অধিবেশনে যোগদান করতে প্রথমবারের মত ঢাকায় আসেন তখন মোতাহের হোসেনের বাড়িতে উঠেন। মোতাহের হোসেনের স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীর সাথে ফজিলতুন্নেসার খুব ভালো সখ্যতা ছিলো। মোতাহের হোসেন নিজেও ফজিলতুন্নেসাকে আপন বোনের মত মনে করতেন। এই বাসাতে তার আসা যাওয়া ছিলো।

১৯২৮ সালে দ্বিতীয়বার আবার যখন কবি ঢাকায় আসেন তখন ফজিলতুন্নেসা জানতে পারেন নজরুল হাত দেখতে জানেন। তাই তিনি মোতাহের হোসেনকে অনুরোধ করেন কবিকে নিয়ে তার বাসায় যাবার জন্য। ফজিলতুন্নেসা তখন ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের হাসিনা মঞ্জিলে থাকতেন। সেই বাসাতেই মোতাহের হোসেন কবিকে নিয়ে যান এবং তাদের দুইজনের পরিচয় হয় এই দেখাতেই নজরুল ফজিলতুন্নেসার প্রেমে পড়ে যান। ফিরে এসে সেদিন রাতেই কবি আবারো ফজিলতুন্নেসার বাসায় যান এবং প্রেম নিবেদন করেন। ফজিলতুন্নেসার কোন অনুরাগ ছিলোনা কবির প্রতি। তিনি কবির প্রেম নিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তাকে ফিরিয়ে দেন। এরপর নজরুল কলকাতায় ফিরে যান এবং ফজিলতুন্নেসাকে চিঠি লিখেন কিন্তু কোন উত্তর পাননি। একইসাথে তিনি মোতাহের হোসেনকে একের পরে এক চিঠি লিখতে থাকেন, যার বর্ণে বর্ণে ছিলো ফজিলতুন্নেসার প্রতি তার আকুলতার কথা। কবির প্রেমের চিঠিগুলো কাজী মোতাহার হোসেন বন্ধুর হয়ে ফজিলাতুন্নেসাকে পৌঁছে দিতেন। এই চিঠিগুলোর একটি থেকে জানা যায় নজরুল তার “সঞ্চিতা” কাব্যসংকলনটি ফজিলতুন্নেসাকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফজিলতুন্নেসা অনুমতি দেননি। এটি পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করা হয়। শেষ পর্যন্ত ফজিলতুন্নেসা নজরুলকে একটি চিঠি লিখে তাকে আর চিঠি না লিখবার অনুরোধ করেন।

কলকাতা ফিরে গিয়ে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে একটি কাব্যিক চিঠি লেখেন। সেই কাব্যিক চিঠির নাম ছিল রহস্যময়ী’। পরে এই চিঠিটি ‘তুমি মোরে ভুলিয়াছ’ নামে প্রকাশিত হয়। ১৯২৮ সালে ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলক্ষে ‘সওগাত’ কার্যালয়ে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে ফজিলতুন্নেসার উদ্দেশ্যে একটি গান পরিবেশন করেন-‘জাগিলে পারুল কিগো ‘সাত ভাই চম্পা’ ডাকে, উদিলে চন্দ্র-লেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে। চলিলে সাগর ঘু’রে অলকার মায়ার পুরে,ফোটে ফুল নিত্য যেথায়জীবনের ফুল্ল-শাখে।
লন্ডনে পিএইচডি করাকালীন সময়ে ফজিলতুন্নেসার সাথে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ পুত্র শামসোদ্দোহার সাথে পরিচয় ঘটে এবং পরে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর তত্ত্বাবধানে ফজিলতুন্নেসা ও শামসোদ্দোহার বিয়ে হয়। বিয়ের খবর শুনে নজরুল লিখেছিলেন-

বাদল বায়ে মোর
নিভিয়া গেছে বাতি।
তোমার ঘরে আজ
উৎসবের রাতি।।

ফজিলতুন্নেসার প্রতি কবির ভালোবাসা বছর দু’য়েকের মতো ছিল। নজরুলের এই একপেশে গোপন ভালোবাসার কথা কেউ জানতে পারতো না যদি না কাজী মোতাহের হোসেনকে লেখা নজরুলের সাতটি চিঠি পাওয়া না যেত। ফজিলতুন্নেসার কাছ থেকে কোন ধরণের সাড়া না পেয়ে নজরুল একাই নিরবে ভালোবেসে গেছেন।

এই বিদুষী নারী ১৯৭৭ সালে ২১ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। এই মহীয়সী নারীর স্মৃতি রক্ষার্থে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৭ সালে একটি হল নির্মাণ করে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের দুটি হল একই নামে হয়েছে। একটি এই কাহিনীর নায়িকা ”ফজিলাতুন্নেসা”র নামে। অপরটি ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এর নামে। অনেকেই জানেনা ৮৭ সালে নির্মিত হল ”ফজিলাতুন্নেসা”র প্রকৃত পরিচয়।

 

 

 

লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।

 

 

 

 

কিউএনবি/বিপুল/২৩.০৯.২০২২/রাত ৮.০৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit