নাহিদ আজ আকাশের মত একেলা
——————————————-
নাহিদের অফিস মতিঝিলে। আজ সন্ধ্যার পরেও সে অফিস থেকে বের হচ্ছেনা। ইচ্ছা করেই বিলম্ব করছে। এই বিলম্বের কারণ আজ বৃহস্পতিবার, রাস্তায় হেভি ট্রাফিক। জ্যামে পরে থাকতে হবে। এরমধ্যে নয়াপল্টনে আজ বিএনপির সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো। বিএনপি বিশাল শোডাউন করেছে। সমাবেশ ফেরত লোকজনের কারণে রাস্তায় আরও বেশি জ্যাম হতে পারে। সঙ্গত কারণে নাহিদ ইচ্ছে করেই অফিস থেকে বের হতে দেরি করছে।
নাহিদ খুব প্রত্যাশা করছে রুমকী তাকে আজ কল দিবে। কিন্তু দেয়নি। নাহিদ কিছুটা অবাক। ঢাকা শহরে নানান প্রতিকূলতার মাঝে বিএনপি এত বড় একটা সমাবেশ করল, অথচ এ নিয়ে রুমকী কথা বলবেনা তা কি করে হয় ? রুমকীর সঙ্গে কথা বলার ব্যাকুলতা অনুভব করলেও নাহিদ কল দিলনা রুমকীকে। এর আগে রুমকী বলে রেখেছিল, জরুরী প্রয়োজন না হলে নাহিদ যেন তাকে কল না দেয়। রুমকীই কল দিবে। রুমকীর একমাত্র মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। নাহিদের সঙ্গে তার নিয়মিত আলাপচারিতা মেয়ের কাছে এক্সপোজ করতে চায়না সে ।
অফিসের কাজ শেষ হয়েছে। এখন নাহিদ ফ্রি। কাজ নেই বলে ল্যাপটপ ওপেন করে নাহিদ নিউজ মিডিয়া গুলোর অনলাইন ভার্সন দেখতে শুরু করল। জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশনের নিউজপোর্টালস ও অন্যান্য নিউজপোর্টালস গুলো সার্চ করে নাহিদ একটা ধাক্কা খেল। বিএনপি এতবড় সমাবেশ করল অথচ নিউজ মিডিয়া গুলো বিএনপির সমাবেশের সংবাদকে ব্ল্যাক আউট করে ফেলেছে। কোন নিউজ নেই। দু একটি মিডিয়া নিউজ প্রকাশ করলেও খুব কৌশলে উপস্থাপন করেছে। ইমেজ এমন ভাবে ছাপিয়েছে যাতে বোঝা না যায় বেশি লোকজনের সমাগম হয়েছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সার্কুলেশনে জনবহুল জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো বিএনপির নিউজ কভার করেছে এভাবে, বিএনপির সমাবেশে ফখরুল : ড্রোনের নাম শুনলেই আমরা ভয় পাই। সমাবেশের ছবি না ছাপিয়ে প্রথম আলো ড্রোনের ছবি ছাপিয়েছে। সার্কুলেশনের শীর্ষে থাকা আরেক জাতীয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন হেড লাইন করেছে, নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক বিক্ষোভ মিছিল। সমাবেশের সংবাদ ও ছবি না ছাপিয়ে তারা ক্ষুদ্র একটি মিছিলের ছবি ছাপিয়েছে।
নিউজ মিডিয়া গুলোর এরকম সংবাদ পরিবেশনে নাহিদ প্রচন্ড বিরক্তবোধ করল। রাগে, ক্ষোভে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল। নষ্ট রাজনীতির খপ্পরে এখন নষ্ট মিডিয়া। নাহিদ ধিক্কার দিচ্ছে। সংবাদ মাধ্যম হলো সমাজের দর্পন। অসঙ্গতি তুলে ধরা, গঠনমূলক বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনই সংবাদমাধ্যম গুলোর কাজ। কিন্তু বাংলাদেশের নিউজ মিডিয়াগুলো এখন যেন অসৎ ব্যবসায়ীদের রক্ষাকবচ, ঢালে পরিণত হয়েছে। নীলক্ষেতে একদা যে চটি পত্রিকা বের হত, তার সম্পাদক এখন শত কোটি টাকার টেলিভিশনের মালিক। অধিকাংশ মিডিয়া হাউজ গুলোর মালিক শীর্ষ ব্যবসায়ীগণ। বিজনেস টাইকুন থেকে এখন তারা মিডিয়া টাইকুনে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্র ধ্বংসের পিছনে শুধু সরকার বা সরকারী দলই দায়ী নয়। নিউজ মিডিয়া গুলো অন্যতম দায়ী। নাহিদ বিড়বিড় করে গালি দিচ্ছে যেন কাকে।
রাস্তায় যতই জ্যাম থাকুক, রাগে গটগট করে নাহিদ অফিস থেকে বের হয়ে গেল। গাড়ীতে উঠে ড্রাইভারকে বলল, যেদিক দিয়ে মন চায় বাসায় নিয়ে চল আমাকে।
গাড়ী ছুটছে ডিওএইচএস এর দিকে। একটু এগুলেই আবার জ্যাম শুরু হচ্ছে। ড্রাইভারকে এসি বাড়িয়ে দিতে বলল নাহিদ। মোবাইল ফোনটা বের করে রুমকীর ফেসবুক আইডিটা ওপেন করল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে রুমকী একটা ভিডিও সং আপলোড দিয়েছে তার ফেসবুক টাইমলাইনে। নাহিদ ভিডিওটি ফুল স্পিকারে অন করে শুনতে লাগলো। মনে হচ্ছে টিএসসির বারান্দায় মুখোমুখি বসে রুমকী এই রবীন্দ্র সংগীতটি গাচ্ছে –
আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে
আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।
যাব না
যাব না গো, যাব না যে
থাকব পড়ে ঘরের মাঝে
এই নিরালায়,
এই নিরালায় রব আপন কোণে
যাব না এই মাতাল সমীরণে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়েছে। গাড়ী তেজগাঁও সাতমাথা ক্রস করছে। নাহিদ তাকিয়ে আছে বিজি প্রেসের বিল্ডিঙের ফাঁক দিয়ে পশ্চিমাকাশে। ঢাকার আকাশে জোস্ন্যা নেই। সোডিয়াম লাইট আর নিয়ন সাইনের ছড়াছড়ি। পূর্ণিমার চাঁদও ফ্যাকাশে দেখায় ঢাকার আকাশে। এখন পূর্ণিমার সময়, যদিও ফুল মুন নয়। নাহিদের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। রুমকী আজ তুমি কোথায় ?
নাহিদ আজ আকাশের মত একেলা। শুধুই একেলা।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
কিউএনবি/বিপুল/২৩.০৮.২০২২/রাত ১১.৫০