বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৯ পূর্বাহ্ন

লুৎফর রহমান এর জীবনের গল্পঃ জোড়মা

Reporter Name
  • Update Time : শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০২২
  • ৩৭৮ Time View

 জোড়মা
———–
খুব শৈশবে আমি আমার মা’কে হারিয়েছি। ছোটবেলা থেকেই যাকে মা বলে ডাকতাম, তিনি আমার সৎমা, বড়মা। আমার বাবার প্রথম স্ত্রী তিনি ছিলেন। আমার দাদা বেঁচে ছিলেন না। দাদিমা শখ করে তার ছোট ছেলেকে অর্থাৎ আমার বাবাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। বড়মা সংসারে আসলেন বটে কিন্তু তিনি বরাবরই অসুস্থ ছিলেন। এক টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হলেন। বড়মা’র দু সন্তান ছিল। প্রথমে আমাদের সব বড়বোন, এরপরে ভাই। বড় বোনের নাম ছিল জোবায়দা।

বড়মাকে আমরা জোড়মা ডাকতাম। আমার মায়ের পক্ষের সব ভাইবোনেরা জোড়মা ডাকতো। বড়মাকে কেন জোড়মা ডাকতাম তা জানিনা। আমি ভাইবোনের মধ্যে সব ছোট ছিলাম। বড় ভাইবোনেরা জোড়মা ডাকত বলে আমিও জোড়মা ডাকতাম। বড় হয়ে এই জোড়মা ডাকার কয়েকটি কারণ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি।

আমার বড়মাকে আমার বাবা ”জোবায়দার মা” বলে ডাকত। সম্ভবতঃ আমার বড় ভাইবোনেরা এই ডাকের সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়েছে জোড়মা। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের দুই মায়ের জোড়া রূপকে প্রাধান্য দিয়েই ”জোড়মা” ডাক হয়েছে। অথবা জোড়মা সম্বোধন নিয়ে আবেগী এক ধারণা কাজ করত আমার মধ্যে। আমাদের এলাকায় যমজ সন্তানকে ”জোড়া ছাওয়া” বলা হত। আমি ভাবতাম যমজ/জোড়া ভাই, জোড়া বোন থাকলে জোড়া মা থাকবেনা কেন ? বড়মা ছিল আমাদের যমজ মা, জোড়া মা। এই থেকে হয়ত ”জোড়মা”।

আমার নিজের মা মারা গেল। আমার দেখভাল করেন জোড়মা। এক সময় আমাকে স্কুলে দেয়া হল। গ্রামের সকল ছেলে মেয়ের সাথে স্কুলে যেতাম। কাঠ ফাঁটা রোদ মাড়িয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে বাড়ী ফিরতাম। আমাকে দেখে দৌড়ে জোড়মা রান্নাঘরে যেত। বিকাল বেলা আমাদের বাড়ীতে জাউভাত রান্না হত। এটাকে মারি ভাত বলতাম। আলুর ভর্তা, খোসা সহ মসুর ডালের ভর্তা দিয়ে এই মারি ভাত অপূর্ব স্বাদের সৃষ্টি করত। আমার মা নেই, এটা মনে রেখে জোড়মা আমাকে ডিম ভেজে দিত। শীতকালে এই ডিমের সাথে সরিষা ফুলের পেস্ট মিশিয়ে দিতেন। কি অদ্ভুত মজা ছিল সেই ডিম ভাজার।

আমাদের বিরাট যৌথ পরিবার। একবেলাতেই ৪০/৫০ জন মানুষের রান্না করতে হত। পরিবারের লোকজন সহ কামলাদের খাবার রান্না করার একটা বিরাট আয়োজন সব সময় লেগে থাকত বাড়ীতে। জোড়মার নির্দিষ্ট কোন কাজ ছিলনা। কিন্তু সব কাজই তিনি করতেন। ক্ষেতের সবজি অথবা আলু তুলে নিয়ে যাচ্ছে কেউ, কিন্তু জোড়মার চোখ ফাঁকি দেয়ার উপায় ছিলনা। তার শ্যেন দৃষ্টিতে ধরা পড়তেই হবে।
বাড়ীর পিছনে কয়েক একর জমির উপরে আমাদের বাঁশ বাগান। ঝোপ ঝাড় জঙ্গলে পরিপূর্ন সেই বাঁশ বাগানে কেউ বাঁশের কঞ্চি কাটলে, শুকনো গাছপালা কাটলে অথবা মাটির নীচে মেটে আলু (পুড়া আলু, মাছ আলু) তুললে কেমন করে জানি বড়মা টের পেতেন। বাঁশ ঝাড় থেকে তাদের তাড়িয়ে দিতেন।

একদিন দুপুর বেলা স্কুল থেকে ফেরার পর জোড়মা আমাকে খেতে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। আমি খেতে খেতেই দেখলাম রান্না ঘরের বাঁশের বেড়ায় গোঁজানো একটা কাগজের পুটলি দুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। আমি খাওয়া ছেড়ে দৌড়ে যেয়ে পুটলি হাতে নিয়ে খুলে ফেললাম। কাগজের পুটলি খোলার পর আমার সমস্ত শরীরে একটা হিম স্রোত বয়ে গেল। পুটলির ভিতরে দুইটা দশ টাকার এবং একটা পাঁচ টাকার নোট। পঁচিশ টাকা এভাবে আমার হাতে চলে আসবে, আমি ভাবতেই পারিনি। আমি এই টাকা হাফ প্যান্টের পকেটে দ্রুত ঢুকিয়ে ফেললাম।
রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে আমি হিসাব করি, ১ টাকা ১০ পয়সা সিনেমার টিকিটের দাম হলে আমি কয়বার সিনেমা দেখতে পাব ? আমি হিসাব মিলাতে পারিনা। একা একা সিনেমা দেখার সাহস হলোনা, ফুটবল কিনতে হবে। পঁচিশ টাকার গরমে রাতে আমি ছটফট করলাম। ঘুম যেন আসতেই চায়না।

পরের দিন সকালে স্কুল গিয়েছি, আচার চানাচুরের দোকান দেখে বারবার পকেটে টাকার স্পর্শ নিচ্ছি। কিন্তু টাকা ভাঙানোর সাহস হচ্ছেনা। হটাৎ করে মনে হল এই টাকা জোড়মার। সহজ সরল এই মানুষটি রান্না ঘরের বাঁশের বেড়ার মধ্যেই টাকা গুঁজে রাখবে। এছাড়া কেইবা আর এভাবে টাকা রাখবে ?
স্কুল থেকে ফেরার পর জোড়মাকে একজন অপরিচিত মানুষ মনে হচ্ছে। তিনি যেন এক ঘোরের মধ্যে আছেন। চোখ তার ফোলা ফোলা। আমি জোড়মাকে বললাম, কি হয়েছে তোমার ? আমার এই জিজ্ঞাসার অপেক্ষায় যেন তিনি ছিলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। বাবারে আমার সর্বনাশ হয়েছে। আমার এক কুড়ি পাঁচ টাকা হারিয়ে গেছে। জোড়মার কান্না দেখে আমিও কেঁদে ফেললাম। পকেটে হাত দিয়ে জোড়মার হাতে টাকাটা দিতেই তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন। তুই কোথায় পেলি এ টাকা ? আমি স্ববিস্তারে টাকা পাওয়ার ঘটনাটি খুলে বললাম। জোড়মা হারানো টাকা পেয়ে আমাকে জড়িয়ে আবারও কান্না শুরু করলেন। মা কাঁদছে, আমি কি করি ? আমিও কাঁদতে শুরু করলাম।

 

 

পাদটীকাঃ আমাদের পাট চাষ করত। প্রতি বছর আমরা ২/৩ শ মন পাট পেতাম। জাগ দেয়া পাট থেকে পাটের আঁশ ছড়ানোর সময় কিছু পাট, পাটকাঠিতে জড়িয়ে থাকত। পাটকাঠি শুকিয়ে গেলে সেখান থেকে এই উচ্ছিষ্ঠ পাট আলাদা করত জোড়মা। এই উচ্ছিষ্ঠ পাটকে ”থেইসমা” বলা হত। জোড়মার ২৫ টাকার উৎস ছিল থেইসমা থেকে। পাটের মৌসুমে পাটের ছোট পাইকাররা এই থেইসমা কিনত। বোনদের মধ্যে বড়বোন জোবায়দার আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিলনা। এভাবেই টাকা জমিয়ে জোড়মা তার আদরের মেয়ে জোবায়দার কাছে টাকা পাঠাত গোপনে।

১৯৭৮ সালে দীর্ঘ রোগশোকে জোড়মা মারা গেলেন। তাঁকে কবর দেয়া হল আমার মায়ের কবরের সাথে। আমাদের জোড়া মা একসাথে চির নিদ্রায় শায়িত এখন। প্রতিদিন অন্ততঃ একবার নামাজ শেষে সুদূর ঢাকা থেকে বাবা মায়ের কবর জেয়ারত করি। চোখ বন্ধ করে যখন নিজেকে কবরস্থানে হাজির করি, আমি স্পষ্টতঃ দেখতে পাই, আমার দুই মা, জোড়া মা একসাথে শুয়ে আছে অনন্ত কালব্যাপী।

 

 

লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট।

কিউএনবি/বিপুল/২০.০৮.২০২২/ রাত ১১.২২

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

April 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit