বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫৬ অপরাহ্ন

অভিবাসনের সুখ-বিড়ম্বনা (পর্ব-১৪)

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০২২
  • ২০২ Time View

ডেস্ক নিউজ : কেলগেরি শহরে গরমকালে বেলা যেন ডুবতে চায় না! জুলাই মাসে প্রায় ষোলো ঘণ্টা দিন আর মাত্র আট ঘণ্টা রাত। শীতের দেশের মানুষ মন-হৃদয় উজাড় করে প্রকৃতির খেলাকে উপভোগ করে। রাত যখন দশটা তখনো সূর্যকিরণে পশ্চিম আকাশ ঝলমল করে। রাতের খাবার দিনে খেতে হয়, এ যেন ডিনারের এক অন্যরকম রূপ; যার সঙ্গে নিজেকে মেলাতেও বেশ সময় লাগে।

মিন্টুদা বুয়েট পাশ প্রকৌশলী। বড় মেয়ের বয়স যখন চার, তখন স্কিলড মাইগ্রেশনে কানাডায় এসেছেন। সেদিনের ছোট্ট মেয়েটি একাদশের ছাত্রী, একথা বলতেই মিন্টুদার গলার কণ্ঠ যেন ক্ষীণ হয়ে আসে, মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে উঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রকৌশল ক্যাডারে চাকুরি পেয়েছিলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। কষ্টে সৃষ্টে বাবা-মা শিক্ষার খরচ যুগিয়েছিলেন। বেতন-ভাতা যা পেতেন বাবা-মায়ের দেখভাল আর ছোট ভাই-বোনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে কোনোরকম কষ্টে সৃষ্টে জীবন চলতো। তবুও বাবা-মায়ের কঠিন শর্ত, দুর্নীতি আর উৎকোচ থেকে দূরে থাকতে হবে। এভাবে চলতে চলতে বিয়েটাও সঠিক সময়ে হয়নি। দৈনন্দিন জীবনে নূন আনতে পান্তা ফুরালেও, কর্মজীবনে সততার কারণে সহকর্মীদের সমীহ ছিল। এটিকে প্রশান্তি ভেবে জীবনটা এগিয়ে যাচ্ছিল।

মিন্টুদার আর্থিক জীবনে অসচ্ছলতা থাকলেও ভালো মানুষ হিসেবে এলাকায় বেশ সুনাম ছিল। আর এ কারণেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ করেই এলাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। বা-মা আর আত্মীয় স্বজনদের সিদ্ধান্তের প্রতি অমত বা অশ্রদ্ধা দেখানোর মতো শক্তি সাহস কোনোটাই সেদিন ছিল না। মধুচন্দ্রিমা কাটতে না কাটতেই স্ত্রীর ভোগ-বিলাসের দাবিতে জীবন অস্থির হয়ে উঠতে শুরু করে। বাবা-মা, আর ভাই-বোনের প্রতি দায়িত্ব পালন অসম্ভব হয়ে পড়ে। সৎ পথে থেকে পরিবারের দাবি মেটানোর সমস্ত পথ যখন রুদ্ধ, বিকল্প ভাবনা থেকেই অভিবাসনের চিন্তা মাথায় আসে। আর এভাবেই একদিন উত্তর আমেরিকার সুখী দেশ বলে কথিত কানাডার স্থায়ী অভিবাসী হয়ে উঠেন।

দেশসেবার মনোবাসনা বিসর্জন দিয়ে অভিবাসী জীবনকে বেছে নিলেও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জে তিনি নাকি আরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন! সংস্কৃতি আর আইন কানুনের গ্যাঁড়াকলে তিনি আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যে সন্তান-সন্ততির সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পরবাসী হয়েছিলেন, সেই ভবিষ্যৎ ভাবনা আজ তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সব পিতা-মাতাই চান নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ আর ধর্মীয় অনুশাসনে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠুক। এর ব্যতিক্রম পিতা-মাতাকে শঙ্কিত করে, ভাষা হারিয়ে গেলে জাতিসত্তা হারিয়ে যায়, সংস্কৃতি হারিয়ে গেলে প্রজন্মের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে। কী ভয়াবহ বিষয়, এর দুটিই নাকি চ্যালেঞ্জের মুখে।

জাত-পাত, ধর্ম, বর্ণ- এর সবই তো উত্তরাধিকারে পাওয়া। আমাদের সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা আর সংস্কৃতি শিশুকাল থেকেই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানকে তফাৎ করতে শিখায়। ‘গোষ্ঠী, গোত্র, বংশ মর্যাদায় সব মানুষ এক নয়’- এমন ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠতে শিক্ষা দেয়। একাডেমিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ক্লাসের সেরা ছাত্রটিকে তারই বন্ধুরা সমীহ করে, এমন এক সাম্যহীন শিক্ষা সংস্কৃতির পরিবেশ তৈরি করে। শিশুকাল থেকে এমন পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে শিক্ষা নিয়ে, আমরা হৃদয় দিয়ে কামনা করি, ধ্যান-ধারণা আর সংস্কৃতিতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও একই বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠুক। অন্যদিকে কানাডার শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাপনায় ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতের বিপরীতে ‘সকল মানুষ এক’- এমন ভাবনা নিয়ে শিশুকাল শুরু হয়ে তারুণ্য আর যৌবনের পথকে পাড়ি দিয়ে নতুন প্রজন্ম একদিন দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠে।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কানাডার শিক্ষা, সংস্কৃতি আর সমাজ ব্যবস্থার সব রীতিনীতিই আমাদের মনোজগতে লুকিয়ে থাকা ভাবনার প্রতিকূলে কাজ করে, আর তখন রাষ্ট্রীয় আইন আর বিধি-বিধানকেও বৈরী মনে হয়। ফলশ্রুতিতে পিতা-মাতা, আর সন্তান সন্ততির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক বৈশিষ্ট্যের কারণে গৃহাভ্যন্তরে তৈরি হয় এক ভয়াবহ সাংস্কৃতিক সংঘাত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ সংস্কৃতি আর রীতিনীতি যখন ‘সকল মানুষ এক’- এমন ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠার শিক্ষা দেয়, তখন পিতা-মাতা চায় তার পরবর্তী প্রজন্ম ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতকে বিবেচনায় নিয়ে বেড়ে উঠুক। এই দুই বিপরীত পরিস্থিতিতে তৈরি সাংস্কৃতিক সংঘাত শিশুমনে বৈকল্য তৈরি করে, কোনো কোনো সময় সন্তান-সন্ততি ভাবতে শুরু করে তার বাবা-মা বর্ণবাদ বা ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন! পিতা-মাতা চায় চিন্তা, চেতনা ও বিশ্বাসে সন্তান তাদের মতো হয়ে উঠুক। আর সন্তান ভ্রান্ত ধারণায় বিশ্বাসী বাবা, মায়ের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে নানা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, কখনো বা আইনের আশ্রয় নিতেও পিছ-পা হয় না।

একাদশের ছাত্রী মিন্টুদার মেয়ের এক সাদা চামড়ার বন্ধু প্রায়শই তার বাসায় আসে। এ নিয়ে পিতা-মাতার অস্বস্তির সীমা নেই। বাবা-মা কখনো মেয়েকে ধর্ম, বর্ণের ভিন্নতা বোঝাতে চেষ্টা করেন, আবার কখনো বা বকাঝকা করেন। মেয়ে যখন ‘মানুষ হিসেবে সবাই সমান’- এমন ধারণা নিয়ে এগিয়ে যায় বাবা-মা তখন জাত-পাতের শিক্ষা দেন। মেয়ে যখন ভাবতে থাকে- বাবা-মায়ের শিক্ষায় ঘাটতি আছে, পিতা-মাতা তখন সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের তাড়নায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েন। দিন যত গড়িয়ে যায়, বাবা-মায়ের অনুশাসনের তীব্রতা ততই বৃদ্ধি পায়। বকাঝকা আর দুয়েকটি চড় থাপ্পরকে বাবা-মা যখন অধিকার হিসেবে বিবেচনা করেন, মেয়ে সেটিকে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বা অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস হিসেবে ভাবতে শুরু করে।

এভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেড়ে উঠা নিয়ে চিন্তাক্লিষ্ঠ মনে প্রতিদিনই বাবা-মা কাজে যান। অজানা শঙ্কা নিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে সন্ধ্যারাতে বাড়ি ফেরেন। স্কুলফেরত মেয়ে দুটিকে কয়েক ঘণ্টা একাকী থাকতে হয়। এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মেয়ের সাদা বন্ধুটিকে বাসায় দেখে মিন্টুদা খেই হারিয়ে ফেলেন। সাত-পাঁচ না ভেবে বকাঝকার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেয়েকে দুটো চড়-থাপ্পড় মারেন। মেয়ের বন্ধুটি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের সাক্ষী হয়ে ৯৯৯-এ কল করে নাগরিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে পুলিশে খবর দেন। মিনিট দশেকের মধ্যে বাড়ির চারপাশ পুলিশ ঘিরে ফেলে। ভেতরে প্রবেশ করে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ঘটনা নিশ্চিত হয়। মিন্টুদার কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকেই গুরুত্ব দেয় না পুলিশ। আইন তার আপন গতিতে চলে। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অপরাধে খাঁচাবন্দি করে একদল পুলিশ মিন্টুদাকে নিয়ে চলে যায়। আরেক দল পুলিশ মেয়ে দুটোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মায়ের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকে।

৮টা বাজে বাড়ি ফিরে পুলিশ দেখে মিন্টুদার স্ত্রী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। ফোন করে পারিবারিক শুভাকাঙ্ক্ষীদের ডাকতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। মায়ের জিম্মায় মেয়ের নিরাপত্তার লিখিত গ্যারান্টি দিলে পুলিশ পরবর্তী করণীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে মেয়েটির সঙ্গে একান্তে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিদায়ের পর বৌদি সাহায্যের প্রত্যাশায় পারিবারিক শুভাকাঙ্ক্ষীদের ফোন করতে শুরু করে। ঘটনা শুনে কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীই আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার সুযোগ দেয় না। রাত-বিরাতে কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না। এমন পরিস্থিতিতে চরম উদ্বেগ উৎকন্ঠা আর বিষণ্নতার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া অন্য কিছুই করার থাকে না। পরদিন নানা পথ ঘুরে কমিউনিটি নেতাদের সহযোগিতায় আইনজীবীর হাত ধরে আদালতের দারস্থ হন।

নয় দিন কারাগারে কাটিয়ে নানা শর্তে মিন্টুদা জামিন পান। সেই থেকে পুলিশ ভেরিফিকেশনে আটকে যাওয়ার ভয়ে প্রফেশনাল চাকরির পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করে দিয়েছেন। দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় প্রতিদিনই নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চান। মেয়ের বয়স আঠারো না হওয়া অবধি কানাডা ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই। আইন-আদালতের নানা শর্তে আটকা পড়ে বুকের যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখে মুখাবয়বে কৃত্রিম হাসি নিয়ে সমাজে বেঁচে আছেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈপরীত্যের কারণে এমন পারিবারিক সংকটে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক না হলেও, কানাডার প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এটি যে ক্রমেই দুটো প্রজন্মের মধ্যে বিরাজমান বিশ্বাস আর চিন্তা চেতনা থেকে সৃষ্ট এক ভয়াবহ সামাজিক সমস্যায় রূপ নিচ্ছে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

নিজের ধর্ম, বিশ্বাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতি বিবর্জিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চয়ই কোনো অভিবাসীর প্রত্যাশিত নয়। যে সন্তানদের সুখী ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় অগণিত মিন্টুদা অভিবাসী হয়েছেন, বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতি বিবর্জিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠলেও মিন্টুদাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিবারণের উপায় কোথায়?

লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক

 

 

কিউএনবি/আয়শা/০৪ অগাস্ট ২০২২, খ্রিস্টাব্দ/রাত ৯:২৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit