জীবন খাতার প্রতি পাতা- ১
———————————
৭ই জুন ২০২২ খ্রিস্টাব্দ। কাঠ ফাটা রোদ কোলকাতাতে। সাদা এসি ট্যাক্সি পাচ্ছিনা। নন এসি হলুদ ট্যাক্সি নিয়েই সদরস্ট্রিট থেকে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌছুলাম। শিয়ালদহ থেকে নৈহাটী আপ ডাউন ট্রেনের টিকেট একসঙ্গেই কাটলাম। মাত্র ২০ রুপি টিকিটের দাম।
আমন্ত্রনটা মোহনাদি ও সংকেত দা’র পক্ষ থেকে। মোহনা গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে কয়েক বছর যাবৎ ফেসবুকে সম্পৃক্ত। কিন্তু এর আগে আমাদের কখনো দেখা হয়নি। ড. সংকেত গঙ্গোপাধ্যায় মোহনাদির হাজব্যান্ড। দিদির কারণেই পরবর্তীতে সংকেত দার সঙ্গে সখ্যতা বেশিই গড়ায়।
সংকেত’দা ভারতের কোচবিহার, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিনাজপুর বাংলাদেশের রংপুর বিভাগ অতঃপর আমার নিজ জেলা কুড়িগ্রামের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন। মাঝে মাঝে আমি নিজেই বিস্মিত হয়ে পড়ি, আমার নিজ এলাকা সম্পর্কে তিনি আমার চেয়েও অনেক বেশি জানেন।
শিয়ালদহ থেকে নৈহাটি এক ঘন্টার ট্রেন জার্নি। এই এক ঘন্টার মধ্যে সংকেত দা কমপক্ষে ৫ বার ফোন করেছেন আমাকে। এখন তুমি কোথায়?
মোহনাদি ও সংকেত দা থাকেন হুগলী জেলা শহরের সদর চুঁচড়াতে। নৈহাটি রেলস্টেশন থেকে নেমে রিক্সায় যেতে হবে গঙ্গা নদীর তীরে ফেরিঘাটে। চুঁচড়া যাওয়ার প্রধান উদ্যেশ্য দাদা দিদির সাথে সাক্ষাৎ। মোহনা’দি দীর্ঘদিন মান্নাদের সহশিল্পী হিসাবে গান করেছেন। আমার স্বপ্ন পুরুষ মান্নাদে। তিনি আজ প্রয়াত। তাঁর সঙ্গে দেখা করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু তাঁর সহশিল্পী মোহনা দি আছে। সেটাইবা কম কি ?
ফেরীতে গঙ্গা পার হয়ে ঘাটেই পেলাম সংকেত দাকে। দাদা দিদির বাসা চিনতে আমার যেন কষ্ট না হয়, সেজন্যেই ঘাট থেকেই আমাকে রিসিভ করতে এসেছেন দাদা।
চুঁচড়া ফেরিঘাট থেকে দিদির বাসা যেতে যত ঐতিহাসিক স্থাপনা সামনে পড়েছে তার নিখুঁত ইতিহাস তুলে ধরছেন সংকেতদা। সামনে বিশাল তোরণ। হুগলী মোহসিন কলেজ। দাদা শুরু করলেন দানবীর হাজী মহম্মদ মহসীন ও তাঁর সৃষ্ট এই কলেজের ইতিহাস দিয়ে। ইতিহাস বর্ণনার এক পর্যায়ে জানতে পারলাম হুগলী মহসিন কলেজের ছাত্র ছিলেন বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী শ্যামল মিত্র। হুগলী কলেজ ফুটবল টিমের দুর্দান্দ গোল কিপার ছিলেন শ্যামল মিত্র।
আমার এই আজকের লেখার প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছে ৩৫ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মোহাম্মদ মহসিন হল গেটে। সন্ধ্যা হলেই হল গেট সংলগ্ন শহীদের চায়ের দোকানে আড্ডা বসত। এই আড্ডা ছিল অতি উচ্চমার্গের। সংগীত ও সাহিত্য নিয়ে আমাদের আড্ডা চলত রাত ১০ টা অবধি।
জাকির হোসেন কামাল ভাই, গাউস ভাই, হলের ভিপি এমদাদ ভাই অতঃপর আমার বন্ধু, ৯০ এর হল সংসদে মহসিন হলের জিএস সাঈদ সোহরাব ছিল এই আড্ডার শিরোমনি। সংগীত সাহিত্য, কবিতা বিষয়ে বিস্তর জ্ঞান রাখতেন জাকির হোসেন কামাল ভাই ও সাঈদ সোহরাব। এই আড্ডায় আমি সাঈদ সোহরাবের মাধ্যমে শ্যামল মিত্রকে বিশেষ ভাবে আবিষ্কার করি। সাঈদের বর্ণনা মতে কিছুটা সর্দি গলা মনে হবে শ্যামল মিত্রের কণ্ঠকে। বাংলাদেশে বিখ্যাত তার গানটি শুরু করত সাঈদ। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া সূর্যকন্যা ছবিতে শ্যামল মিত্র এই গানটিই গেয়েছিলেন। চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা, ভালোবাসো যদি কাছে এসোনা।
সংকেতদা আমাকে হুগলী মোহসিন কলেজের মাঠে নিয়ে প্রবেশ করলেন। ভর দুপুরবেলা। প্রচন্ড রোদ। কলেজ বন্ধ, চারিদিকে শুনশান নীরবতা। আমার কানে তখন বাজছে শ্যামল মিত্রের আরেকটি সাড়া জাগানো গান। গানটিকে বাস্তবে টেনে নিয়ে আসলাম মোবাইল সেটে ইউটিউব অন করে।
জীবন খাতার প্রতি পাতায়
যতই লেখো হিসাব-নিকাশ
কিছুই রবে না
লুকোচুরির এই যে খেলায়
প্রাণের যত দেয়া-নেয়া
পূর্ণ হবে না
কণ্ঠ ভরা এ গান শুনে
ছুটে তুমি এলে দ্বারে
চোখে দেখে এত করেও
চেনোনি তো কভু তারে
অবহেলা সয়েও তবু
আমায় তুমি নাও গো ডেকে
সে তো কবে না
যে আঁখি হয় না খুশি
আকাশ ভরা তারা দেখে
সেই হাসে কাঁচের ঝাড়ে
মোমের বাতি জ্বেলে রেখে
জানি আমি আমারে নয়
এ গান আমার ভালোবাসো
নিজের ভুলে পথের ধুলায়
পরশ মাণিক ফেলে আসো
তোমার প্রাণের ঐ ঠিকানায়
দেখেও আমায় তবু কি গো
ডেকে লবে না।
পাদটীকাঃ খুব স্বল্প সময় চুঁচড়াতে অবস্থান করেছি। কিন্তু এই স্বল্প সময়েই ড.সংকেত গঙ্গোপাধ্যায় খুব নিখুঁত ভাবেই উপস্থিত করাতে পেরেছিলেন হুগলী মোহসিন কলেজের ছাত্র সংগীত শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ আরও অনেককেই। কলেজ সংলগ্ন মান্নাদের নানা বাড়ীতে তাঁর দুরন্ত কৈশোরপনা, হুগলীর আরেক সন্তান শরৎ চন্দ্র চট্টপাধ্যায় সহ আরও অনেকের কথা নিয়েই পরবর্তী লেখাগুলো আসবে ইনশাআল্লাহ।
ছবিঃ ১. মোহনা গঙ্গোপাধ্যায় ২. হুগলী মোহসিন কলেজ গেটে লেখক। ৩. শ্যামল মিত্র। ৪. মোহনা দি, ও সংকেত দা।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
কিউএনবি/বিপুল/১৬.০৭.২০২২/দুপুর ১২.৩০