এম এ রহিম চৌগাছা (যশোর) : যশোরের চৌগাছায় ৯ম শ্রেণিতে পড়–য়া দুই প্রেমিক টগর (১৫) এবং প্রেমিকা মীম (১৪) একসাথে আগাছানাশক পানে আত্মহত্যা চেষ্টার পর প্রেমিকার মৃত্যুর ঘটনায় যশোরের আদালতে হত্যা মামলা হয়েছে। ১৯ জুন রবিবার মীমের মা ও ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারের আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী পারভীন বেগম এই মামলা করেন। কোমল পানীয়র সাথে কীটনাশক পান করিয়ে হত্যার অভিযোগে প্রেমিক টগর, তার ভাই যশোর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী সাগর (১৯) এবং মা নাজমা আক্তারকে (৩৬) আসামি করেন।
মীম চৌগাছা উপজেলার জগদীশপুর গ্রামে মামা বাড়ি থেকে জগদীশপুর-মির্জাপুর ইসমাইল হোসেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতো। গত ৮ জুন সে ও তার প্রেমিক বিদ্যালয় ভবনের পিছনে আগাছানাশক পানে আত্মহত্যার চেষ্টার পর ১০ জুন দুপুরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় মীম। আর টগর বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। যশোরের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সালমান আহমেদ শুভ অভিযোগটি গ্রহণ করে এ ঘটনায় থানায় পূর্বে কোনো মামলা রাজু না হলে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার জন্য চৌগাছা থানার ওসিকে নির্দেশ দেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, মীম জগদীপুর মির্জাপুর ইসমাইল হোসেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণিতে পড়তো। আসামি টগর প্রলোভন দেখিয়ে মীমের সাথে প্রেমের স¤পর্ক গড়ে তোলে। বিষয়টি টগরের পরিবার জানতে পেরে মীমকে নানাভাবে হুমকি দিয়ে আসছিলো। এ নিয়ে সালিশে টগরের পরিবার মীমের পিতাকে মারপিট করে। মীম ক্ষোভে টগরের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। এতে টগর অভিমান করে ঘুমের ঔষুধ সেবন করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। গত ২৫ মে অপর দুই আসামি মীমদের বাড়িতে এসে স্কুলে যেতে নিষেধ করে গলিগালাজ ও খুন জখমের হুমকি দিয়ে যায় মীমকে। গত ৮ জুন মীম স্কুলে পরীক্ষা দিতে গেলে আসামিরা স্কুলে যেয়ে গলিগালাজ করে আসে। সকাল পৌনে ১০ টার দিকে আসামিরা কৌশলে মীমকে ক্লাশ রুম থেকে ডেকে কোমল পানীর সাথে গন্ধবিহীন কীটনাশক পান করায়। গুরুতর অসুস্থ মীমকে প্রথমে চৌগাছা পরে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে স্বজনেরা। অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ জুন দুপুরে মীম মারা যায়।
এর আগে গত ৮ জুন সকালে বিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষা শুরুর আগে বিদ্যালয় ভবনের পিছনে গিয়ে একসাথে আগাছানাশক পান করে মীম (১৪) ও টগর (১৫)। পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ জুন দুপুরে মারা যায় মীম। একইদিন চিকিৎসার পর একই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয় টগরকে। এরপর দিন ১১ জুন টগরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে পরিবার। গত শুক্রবার (১৭ জুন) থেকে টগর সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন বলে সোমবার বিকেলে মোবাইলে জানান, তার বড়ভাই ও যশোর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী সাগর হোসেন (১৯)। সাগর সেখানে ভর্তি রেজিষ্টার এবং টগরের চিকিৎসাধীন অবস্থার ছবিও এ প্রতিবেদককে হোয়াটসঅ্যাপে দিয়েছেন।
মীম যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলো তখন পুলিশ, মীম ও টগরের পরিবারিক সূত্র এবং স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানিয়েছিলেন, উভয়ের পরিবার প্রেমের সম্পর্ক না মেনে নেয়ায় একসাথে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা দুই জন। পরে আগাছানাশক জোগাড় করে ৮ জুন সকাল ১০ টায় স্কুলে চলাকালীন পরীক্ষা না দিয়ে বিদ্যালয়ের মূল ভবনের পিছনে যেয়ে প্রথমে মীম ও পরে টগর আগাছানাশক পান করে। এরপর দুই জনে পরীক্ষার হলে যেয়ে পরীক্ষা দিতে শুরু করে। প্রায় আধাঘণ্টা পরীক্ষা দেয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে মীম। শিক্ষকরা জানতে চাইলে স্বীকার করে সে এবং টগর আগাছানাশক খেয়েছে। তবে টগর সে সময় অস্বীকার করে শিক্ষকদের বলে সে বিষ খায়নি, শুধুমাত্র মীম খেয়েছে। এরপর স¤পূর্ণ পরীক্ষা দেয় টগর। তখন সবাই ভেবেছিলো টগর আগাছানাশক খায়নি।
সে সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মীমকে উদ্ধার করে চৌগাছা উপজেলা সরকারি মডেল হাসপাতালে নিলে প্রাথমিকচিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে রেফার করে। সেখানে মীমের মা সাংবাদিকদের জানান, তার মেয়েকে বিষ খাইয়ে দিয়ে প্রেমিক টগর পালিয়ে যায়। তখন তিনি টগরের আগাছানাশক খাওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান। যশোরে মীমের অবস্থার অবনতি হলে বৃহ¯পতিবার তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০জুন শুক্রবার দুপুওে মীমের মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে পরীক্ষা শেষে বাড়িতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে টগরের পরিবার তাকে চৌগাছা উপজেলা সরকারি মডেল হাসপাতালে নেয়। তাকেও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখান থেকে টগরকেও পরদিন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে চিকিৎসার পর শুক্রবার টগরকে ছাড়পত্র দেয়া হয় । পরে ১১ জুন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয় তাকে।সেখানে বর্তমানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন টগর।
এদিকে খুলনা মেডিকেলে মীমের মৃত্যুর পর খুলনার সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় মৃত্যুর বিষয়ে অবহিত করে মীমের বাবা আনোয়ার হোসেন একটি লিখিত বয়ান দেন। সেটি এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেখানে মীমের পিতা লেখেন,আমার মেয়ে মীম (১৪) ৮ জুন সকাল আনুমানিক সাড়ে দশটায় স্কুলে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় আমার ঘরে থাকা ঘাসপুড়া কিটনাশক মোজর বোতলে থাকায় ভূলবসতঃ মোজো মনে করে খাইতে খাইতে স্কুলে পরীক্ষা দিতে যায়। স্কুলে পরীক্ষার সময় সে অসুস্থ হয়ে পড়লে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাকে চৌগাছা হাসপাতালে নেয়। এরপর যশোর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে ওইদিনই বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে খুলনা মেডিকেলে ভর্তি করি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ জুন ১২.৩০ মিনিটে চিকিৎসক আমার মেয়েকে মৃত ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে মর্জি হয়। তখন এ ঘটনায় সোনাডাঙ্গা থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। যার নম্বর ১০২।
এদিকে মেয়েকে দাফনের পরই আনোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী চৌগাছা থানায় টগর ও তার মার নামে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। যেটি চৌগাছা থানা পুলিশ তদন্ত করছেন। তবে টগর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি থাকায় এবং তার স্বজনরা সেখানে অবস্থান করায় তদন্ত সম্পন্ন হয়নি। এর মধ্যেই মীমের মা রবিবার আদালতে মামলা করেন এবং সেখানে বলেন চৌগাছা থানা মামলা নেয়নি। এদিকে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মীমের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায় এবং তাকে নিয়ে বসবাস করায় তার মা মীমকে নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে নিজের বাবার বাড়ি জগদীশপুর গ্রামে বসবাস করছেন। মীমের বাবা পরিবারের কোনো খোঁজ নিতেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে মীমের বড় দুই বোনেরও প্রেমের স¤পর্কের সূত্রে বিয়ে হয়েছে।
চৌগাছা থানার ওসি সাইফুল ইসলাম সবুজ বলেন, অপরিণত বয়সের প্রেমের স¤পর্কের সূত্র ধরে উভয়েই একসাথে আগাছানাশক পান করে তারা। প্রায় ত্রিশ মিনিট পরীক্ষা দিয়ে মীম অসুস্থ হয়ে পড়ে। টগর স¤পূর্ণ পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষার হলে মীম অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয় শিক্ষকরা। বাড়ি থেকে পরিবারের সদস্যরা হাসপতালে নেয় টগরকে। উভয়কে যশোরে রেফার করা হয়। সেখান থেকে উভয়কে খুলনায় রেফার করা হয়। সেখানে শুক্রবার দুপুরে মীম মারা যায়। তিনি আরো বলেন, টগর বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন বলে তার বড়ভাইয়ের মাধ্যমে মোবাইলে শুনেছি।
কিউএনবি/আয়শা/২০.০৬.২০২২ খ্রিস্টাব্দ/রাত ৯:২৮