ডেস্ক নিউজ : মুসলিম সভ্যতা এমন এক সময়ে বিকশিত হয়েছিল যখন আফ্রো-ইউরেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক বৃহৎ আঞ্চলিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্য, ধর্মের বিস্তার এবং জ্ঞান লিপিবদ্ধ করার ব্যাপক প্রচলন মানবচিন্তার বৃহৎ উত্তরাধিকার সংরক্ষণ করে রেখেছিল। প্রধান প্রধান সভ্যতা জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতের মতো বিষয়কে এগিয়ে নিয়েছিল। আর দর্শন ও নীতিশাস্ত্র জ্ঞানতত্ত্বের নানা তত্ত্ব অনুসন্ধান করতে শুরু করেছিল।
মানব মেধা তখন অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছিল। যেমন—শুষ্ক ভূমিতে সেচ দেওয়া ও পানি সংরক্ষণ, ধাতু প্রক্রিয়াকরণ, সুতা ও প্রাকৃতিক কাপড় নিয়ে কাজ করা এবং খাদ্য সংরক্ষণের উপায় আবিষ্কার করা।
মুসলমানদের শাসনাধীনে ভূখণ্ডের সম্প্রসারণ, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রসার বহু জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত মানবিক বিনিময়ের মাধ্যমগুলো আরো বিস্তৃত ও ঘনিষ্ঠ হয়েছিল।
বাণিজ্য বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের জন্য মুসলমানদের বহু পণ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হয়েছিল। এর জন্য শহর, রাস্তা, বন্দর, বাঁধ ও সেতু নির্মাণের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও প্রকৌশল জ্ঞানের প্রয়োজন হয়েছিল। মুসলিম প্রকৌশলীরা পূর্ববর্তী সমাজগুলোর অর্জিত ধারণা ও অভিজ্ঞতাগুলোকে ধারণ করে তার সঙ্গে নতুন গণিতের জ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যার উন্নয়ন সাধন করেছিল। ফলে তারা এমন যন্ত্র, উপকরণ ও নির্মাণ কৌশল তৈরি করেছিলেন, যা মানব দক্ষতা ও জ্ঞানকে আরো উন্নত করেছিল।
মুসলিম শাসনামলে মুসলিম বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে চীন, মধ্য এশিয়া ও ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে শুরু করে দূর পশ্চিমের আল-আন্দালুস ও উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত প্রযুক্তিগত ধারণা ও জ্ঞান ছড়িয়ে পড়েছিল। মুসলিম শাসকরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় রচিত বই সংরক্ষণের জন্য লাইব্রেরি নির্মাণ করেন, কারিগরি ও প্রকৌশলবিদ্যায় দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিদের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হতো। তারা নিত্যনতুন ধারণা ও বিদ্যা নিয়ে ফিরে আসত।
বানু মুসা বিন শাকিরের ভাইয়েরা (৮৫০ খ্রিস্টাব্দ) পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিম এলাকার বিখ্যাত উদ্ভাবক ও প্রকৌশলী ছিলেন। তাঁরা প্রকৌশল বিষয়ে ২০টির বেশি বই অনুবাদ ও রচনা করেছিলেন।
তাঁদের কিতাব আল-হিয়াল (The Book of Ingenious Devices)-এ প্রায় এক শ ব্যাবহারিক যান্ত্রিক যন্ত্রের বর্ণনা রয়েছে। তাঁদের কাজ আলেকজেন্দ্রিয়ার হেলেনিস্টিক যান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রভাব বহন করে বলে মনে হয়। কেননা তাঁরা তৃতীয় শতাব্দীর হিরো ও ফিলোর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন। বানু মুসা বিন শাকিরের কিছু যন্ত্র পূর্ববর্তী প্রযুক্তির সঙ্গে মিল থাকলেও অনেকগুলো স্বতন্ত্র ও তাদের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল।
প্রকৌশলে কিছু যান্ত্রিক উপাদান আছে, তা যন্ত্রের এমন অংশ যেগুলো নানা কাজে ব্যবহূত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এমন যন্ত্র যা তরলের স্রোত নিয়ন্ত্রণ করে এবং নির্দিষ্ট চক্রে খোলে-বন্ধ হয়; ক্র্যাংকশ্যাফ্ট ও গিয়ার, যা শক্তি স্থানান্তর করে বা যন্ত্রের গতি ও চলন নিয়ন্ত্রণ করে; র্যাচেট যা গিয়ারকে নির্দিষ্ট দিক থেকে ঘোরা থেকে বাধা দেয় এবং এমন অংশ যা যন্ত্রের শক্তি বাড়িয়ে দেয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রকৌশল অগ্রগতি কিতাব আল-হিয়াল-এ দেখা যায়। এর কিছু উপাদান আধুনিক শিল্পে ব্যবহূত হওয়ার আগ পর্যন্ত পাঁচ শ থেকে হাজার বছর আর কোথাও দেখা যায়নি।
আন্দালুসিয়ার আল-মুরাদি ছিলেন একাদশ শতাব্দীর (১১শ শতক) বিজ্ঞানী, যিনি ‘দ্য বুক অব সিক্রেটস অ্যাবাউট দ্য রেজাল্ট অব থটস’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এতে আরবি ভাষায় প্রথমবারের মতো জলঘড়ি (water clocks) এবং অটোমাটা নামে পরিচিত অন্যান্য যান্ত্রিক যন্ত্রের বর্ণনা পাওয়া যায়। বইটিতে ৩১টি মডেলের বর্ণনা রয়েছে, যা পানিপ্রবাহের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে জলচক্র বা water wheel ব্যবহার করে কাজ করত। এর মধ্যে ১৯টি যন্ত্র ছিল ঘড়ি। এগুলোতে clepsydras নামের একটি উপাদান ব্যবহূত হতো এবং মানব বা প্রাণীর আকৃতির যন্ত্রচিত্রগুলো জটিল গিয়ার ব্যবস্থার মাধ্যমে চলত, যা পারদ দিয়ে লুব্রিকেট করা হতো। এসব উদ্ভাবন এরপর অন্য কোনো সমাজে ১৩ শ শতাব্দী পর্যন্ত দেখা যায়নি।
১২৭৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে কাস্তিলের আলফোনসোর দরবারে ‘লিব্রোস দেল সাবের’ নামক স্প্যানিশ বইটিতে আরবি উৎস থেকে অনুবাদ ও সারসংক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত ছিল। আল-জারকালী নিশ্চয়ই এই জ্ঞানের নাগাল পেয়েছিলেন। কারণ তিনিই ১১শ শতাব্দীতে টলেডোতে দুটি বড় জলঘড়ি নির্মাণ করেছিলেন। জলঘড়িতে আরো যে উপকরণ ব্যবহূত হতো তার মধ্যে ছিল সাইফন (মাধ্যাকর্ষণে প্রবাহিত ছোট নল) ও ফ্লোট ভালভ।
১৩শ শতাব্দীর আল-জাজারি ছিলেন ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ কৌশল বিজ্ঞানী। তাঁর উদ্ভাবিত যান্ত্রিক উপাদানগুলো পরে বাষ্পচালিত ও গ্যাসোলিন ইঞ্জিনেও ব্যবহূত হয়েছে।
এস্কেপমেন্ট (escapements), যা আল-জাজারির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন এবং স্পেনেও ব্যবহূত হয়েছিল যন্ত্রের গতির সঠিক সময় নির্ধারণে অপরিহার্য। এগুলো অটোমাটা
(self-moving machines)-তেও ব্যবহূত হতো, যা মধ্যযুগীয় মুসলিম শাসকদের প্রাসাদে আশ্চর্যজনক প্রদর্শনী হিসেবে রাখা হতো। যদিও এগুলো বিনোদনমূলক মনে হতো, তবু প্রকৃত যান্ত্রিক প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এগুলোর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আরেক ধরনের প্রকৌশল দেখা যায় জনপদ ও স্থাপত্য নির্মাণে। ভারী পাথর বা কাঠের কাঠামো তৈরি করা, যা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং কাজও করে—এটি উচ্চমানের প্রকৌশল জ্ঞানের দাবি রাখে। স্থাপত্যের সঞ্চিত জ্ঞান বলতে বোঝায় কিভাবে ছাদ, দেয়াল ও টাওয়ারের মতো ভবনের অংশগুলোর ওজন বণ্টন করতে হয়, যাতে সেগুলো ভেঙে না পড়ে।
যে খিলান ভবনের মুখ খুলে দেয় সেটিকে পুরো গঠনটির ওজন নিচে নামিয়ে বহন করতে হয়। টাওয়ারকে এমনভাবে ভিত্তি ও বাতাস-প্রতিরোধের হিসাব করে নির্মাণ করতে হয়, যাতে তা মাটিতে বসে না যায়, হেলে না পড়ে বা ভেঙে না পড়ে। নদীর বন্যার পানি আটকাতে যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়, সেগুলোকে নির্দিষ্ট গাণিতিক অনুপাত অনুযায়ী সোজা বা বাঁকানো করে বানাতে হয় এবং এগুলোর জন্য পানি নিয়ন্ত্রণের দরকারি ফটকও প্রয়োজন।
স্পেনে রোমানদের তৈরি একুয়েডাক্ট মুসলিম শাসনামলেও বজায় রাখা হয়েছিল। স্পেনের বহু নদীতে জটিল সেচব্যবস্থা, পানীয়জলের ব্যবস্থা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা মুসলিমরা নির্মাণ করেন। মুসলিমদের নির্মিত প্রাচীনতম বাঁধটি কর্ডোভায় অবস্থিত একটি লম্বা, জিগজ্যাগ আকৃতির দেয়াল, যা সর্বোচ্চ জলের স্তর থেকে প্রায় আট ফুট উঁচু ও আট ফুট পুরু। বাঁধ কোথায় নির্মাণ করা হবে তা নির্ণয়ের জন্য অ্যাস্ট্রোল্যাবের মতো যন্ত্র দিয়ে সার্ভে করা হতো এবং জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতির মতো উন্নত গণিত ব্যবহার করে হিসাব করতে হতো।
বাঁধগুলো নির্মাণে ব্যবহার করা হতো পাথর ও সিমেন্ট, যা বালু, পানি, ছাই ও পোড়া চুন মিশিয়ে তৈরি করা হতো, যাতে তা পাথরের চেয়েও কঠিন হয় এবং ফাটল প্রতিরোধ করতে পারে। এই বাঁধগুলো হাজার বছরেও তেমন মেরামতের প্রয়োজন পড়েনি। এ ছাড়া বাঁধগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হতো, যাতে পানিশক্তি ব্যবহার করে জলচক্র চালানো যায়—যা শস্য পেষণ, কাগজ তৈরির পাল্প পেটানো, পানি তোলা এবং অন্যান্য ভারী শ্রমের যন্ত্র চালাতে কাজে লাগত।
তথ্যঋণ : ইসলামিক স্পেন ও মুসলিম হেরিটেজ
কিউএনবি/অনিমা/১৪ ডিসেম্বর ২০২৫,/রাত ১০:২৪