নিউজ ডেক্স : আধুনিক অর্থনীতি আজ সংখ্যার জাদুতে আবিষ্ট। প্রবৃদ্ধি, সূচক, বাজারমূল্য—সবই বাড়ছে, অথচ মানুষের জীবনে স্থায়িত্ব কমছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিটি বড় আর্থিক বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে একই সূত্র: ঝুঁকিকে দুর্বলদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে শক্তিশালীদের নিরাপদ করা। এই কাঠামো কোনো বিচ্যুতি নয়, বরং সুদ ও ঋণনির্ভর ব্যবস্থার স্বাভাবিক চরিত্র। অর্থনীতিবিদ হাইম্যান মিনস্কি বহু আগেই সতর্ক করেছিলেন—যে ব্যবস্থা সুদের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে স্থিতিশীলতাই একসময় অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়। কারণ ঋণ বাড়তে বাড়তে এমন স্তরে পৌঁছায়, যেখানে বাস্তব উৎপাদন আর আর্থিক দাবির মধ্যে আর কোনো সামঞ্জস্য থাকে না।
আজকের বৈশ্বিক অর্থনীতি ঠিক সেই ফাঁদেই বন্দী—যেখানে কাগুজে সম্পদের পরিমাণ বাস্তব অর্থনীতিকে বহু গুণ ছাড়িয়ে গেছে। ইসলামী অর্থনীতি এই বিপর্যয়ের কেন্দ্রে আঘাত হানে একটি মৌলিক নীতির মাধ্যমে: অর্থ নিজে নিজে মূল্য সৃষ্টি করতে পারে না। মূল্য আসে শ্রম, ঝুঁকি ও বাস্তব উৎপাদন থেকে। এই কারণে ইসলাম সুদকে নিষিদ্ধ করে শুধু নৈতিক কারণে নয়, বরং কাঠামোগত ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। সুদ এমন এক সম্পর্ক তৈরি করে, যেখানে ঋণদাতা লাভ নিশ্চিত করে, আর ঋণগ্রহীতা বহন করে সব অনিশ্চয়তা—এটি অর্থনৈতিক ভারসাম্যের সরাসরি লঙ্ঘন। কম আলোচিত একটি বাস্তবতা হলো, আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা মূলত ‘ঋণ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থ সৃষ্টি’ করে।
অর্থাৎ ব্যাংক আমানতের সমপরিমাণ অর্থ ধার দেয় না, বরং হিসাবের খাতায় সংখ্যা লিখেই নতুন অর্থ তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় সম্পদ সৃষ্টি হয় না, সৃষ্টি হয় দায়। ইসলামী অর্থনীতি এই কৃত্রিম সম্প্রসারণকে প্রত্যাখ্যান করে এবং অর্থকে বাস্তব সম্পদের সঙ্গে যুক্ত রাখে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি ও বুদবুদের ঝুঁকি কাঠামোগতভাবে কমে আসে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু প্রায় অনালোচিত দিক হলো—ইসলামী অর্থনীতিতে সময়ের মূল্য স্বীকৃত হলেও সময়ের ওপর নির্দিষ্ট মুনাফা আরোপ নিষিদ্ধ। আধুনিক অর্থনীতি সময়কে পণ্যে রূপান্তর করে, কিন্তু ইসলাম সময়কে আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে বিবেচনা করে, যার অপব্যবহার সামাজিক অন্যায় ডেকে আনে। এই দর্শন শ্রমঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি ও উৎপাদনের নৈতিক সীমা নির্ধারণে গভীর প্রভাব ফেলে।
ইতিহাস বলছে, ইসলামি সভ্যতার অর্থনৈতিক কাঠামো কেবল দাননির্ভর ছিল না, বরং এটি ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়ের এক বিস্ময়কর উদাহরণ। ওয়াকফ ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা এমনকি রাস্তা ও পানির ব্যবস্থাও রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর না করেই পরিচালিত হয়েছে। আধুনিক অর্থনীতিতে যেখানে জনকল্যাণ ব্যয়কে ‘খরচ’ হিসেবে দেখা হয়, ইসলাম সেখানে একে সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করে। আজ পরিবেশ সংকট মানবসভ্যতার অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। অথচ ইসলামী অর্থনীতি শুরু থেকেই সীমাহীন ভোগকে নিরুৎসাহিত করেছে। ‘ইস্রাফ’ বা অপচয়কে হারাম ঘোষণা করা নিছক নৈতিক উপদেশ নয়, এটি সম্পদের আন্তঃপ্রজন্ম ন্যায্যতার ঘোষণা। আধুনিক টেকসই উন্নয়নের যে ধারণা আজ বিশ্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে, ইসলাম তা শতাব্দী আগেই নৈতিক বিধানে রূপ দিয়েছিল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—ইসলামী অর্থনীতি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ভাঙতে চায়। যাকাত, উত্তরাধিকার আইন ও লেনদেনের বিধান এমনভাবে বিন্যস্ত, যাতে সম্পদ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জমাট বাঁধতে না পারে। এটি আধুনিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার বিপরীত দর্শন, যেখানে ধন ক্রমাগত ধনকেই জন্ম দেয়। ইসলামী অর্থনীতি তাই কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নয়, এটি এক ভিন্ন সভ্যতা-দৃষ্টি। যেখানে বাজার থাকবে, মুনাফা থাকবে, প্রযুক্তিও থাকবে—কিন্তু সবকিছু থাকবে ন্যায়ের অধীন। আজকের বিশ্ব যখন বারবার সংকটে পড়ে একই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়—“এভাবে আর কত?” ঠিক তখনই ইসলামী অর্থনীতি নীরবে বলে, “ভিন্নভাবে শুরু করো।”
কিউএনবি/মহন/১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, সকাল ১১:৪৩