রবিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৪১ পূর্বাহ্ন

মুমিনের অন্তরে খ্যাতির ভয়

Reporter Name
  • Update Time : বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫
  • ৮১ Time View

ডেস্ক নিউজ : কোরআন ও হাদিসে যেসব বিষয়কে মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক বলা হয়েছে খ্যাতির মোহ তার অন্যতম। বিশেষত মুমিনের ধর্মীয় জীবনে এর প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। কেননা তা ইবাদতের নিষ্ঠাকে নষ্ট করে এবং আল্লাহর ভালোবাসা লাভে বাধা সৃষ্টি করে। এ জন্য পূর্বসূরি আলেমরা খ্যাতিম্যান হওয়াকে ভয় পেতেন।

বিখ্যাত সুফি ইবরাহিম ইবনে আদহাম (রহ.) বলেন, ‘যে খ্যাতি পেতে পছন্দ করে সে আল্লাহর ব্যাপারে (নিষ্ঠা ও ভালোবাসার দাবিতে) সত্যবাদী নয়।’
(সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৫/৫৬)

সাঈদ ইবনে মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, ‘প্রশংসা ও খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ থেকে যেভাবে দূরে সরায় অন্য কিছু এভাবে দূরে সরায় না।’

(সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১৪/২১৪)

খ্যাতির তাড়নায় ভয় কেন

একজন মুমিন খ্যাতির প্রবণতা ভয় পায়। কেননা পবিত্র কোরআন ও হাদিসে খ্যাতির মোহ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘এটা আখিরাতের সেই আবাস, যা আমি নির্ধারিত করি তাদের জন্য, যারা এই পৃথিবীতে বড়ত্ব কামনা করে না এবং বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। শুভ পরিণাম মুত্তাকিদের জন্য।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৮৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছাগলের পালে ছেড়ে দেওয়া হলে তা যতটুকু না ক্ষতিসাধন করে, কারো সম্পদ ও প্রতিপত্তির লোভ এর চেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করে তার ধর্মের।’

(সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৭৬)

অন্য হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি খ্যাতি লাভের জন্য পোশাক পরে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সেরূপ পোশাক পরাবেন, অতঃপর তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪০২৯)
 
মুমিনের অন্তরে খ্যাতির ভয়

পূর্বসূরি আলেম ও মনীষীরা খ্যাতিম্যান হওয়াকে ভয় পেতেন। খ্যাতির আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে কয়েকজন বিখ্যাত মনীষীর মনোভাব তুলে ধরা হলো—

১. ইবরাহিম নাখয়ি (রহ.) : তিনি বলেন, ‘একজন মানুষের ফিতনায় পতিত হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে মানুষ তাকে দ্বিন বা দুনিয়ার ব্যাপারে আঙুল তুলে দেখায়; ব্যতিক্রম যাদেরকে আল্লাহ রক্ষা করেন।’

(আল জুহুদ : ২/৪৪২)

২. বিশর ইবনুল হারিস (রহ.) : তিনি বলেন, ‘আমি এমন কোনো ব্যক্তি দেখিনি যে পরিচিতি লাভে আগ্রহী অথচ তার দ্বিনদারি নষ্ট হয়নি এবং তার মন্দ নিয়ত প্রকাশ পায়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রসিদ্ধি লাভ করতে পছন্দ করে সে পরকালের স্বাদ পায় না।’

(ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/২৭৬)

৩. ইবনে তাইমিয়া (রহ.) : তিনি বলেন, ‘এটা স্পষ্ট যে সম্পদ ও খ্যাতির লোভ দ্বিনদারি ধ্বংসের কারণ।

এর ক্ষতি ছাগলের পালে ক্ষুধার্ত নেকড়ের ঝাঁপিয়ে পড়ার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। নিশ্চয়ই ইসলাম পূতঃপবিত্র ধর্ম। এখানে লোভ-লালসার স্থান নেই।’
(মাজমাউল ফাতাওয়া : ১০/২১৫)

৪. আল্লামা ইবনে রজব (রহ.) : তিনি বলেন, ‘প্রকৃত আলেম ও নেককার বান্দারা খ্যাতি অপছন্দ করেন। তাঁরা খ্যাতির কারণগুলো এড়িয়ে চলেন এবং মানুষের আড়ালে থাকার চেষ্টা করেন।’

(মাজমুউ রাসায়িলি ইবনে রজব : ২/৭৫৫)

৫. আল্লামা ইবনে বাত্তাল (রহ.) : তিনি বলেন, ‘কোনো মুসলমানের জন্য উচিত নয় খ্যাতির প্রত্যাশা করা। চাই তা ভালো কাজে হোক বা মন্দ কাজে হোক।’

(তাহজিবুল আসার, পৃষ্ঠা-৩)

৬. ফুজাইল ইবনে ইয়াজ (রহ.) : তিনি বলেন, ‘নেতৃত্বপ্রত্যাশী ব্যক্তিরা অন্যকে হিংসা করে, আল্লাহর অবাধ্য হয়, মানুষের দোষ খোঁজে এবং (সে ছাড়া) অন্য কারো প্রশংসা করা হোক, তা চায় না।’

(ফাতহুল মান্নান : ৩/৩৪৯)

৭. আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) : তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছা করে এমন স্থানে চলে যেতে, যেখানে কোনো মানুষ থাকবে না। আমি মক্কার এমন একটি টিলায় আশ্রয় নিতে চাই, যেখানে আমাকে কেউ চিনবে না।’

(আল জুহুদ : ২/৪৩৫)

বড়ত্বের আকাঙ্ক্ষা দুই প্রকার

মুমিনের ভেতরে খ্যাতি ও বড়ত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা দুই ধরনের হতে পারে। যেমন—

১. নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষা : মুমিন যখন কোনো দ্বিনি কাজ করে, তখন সে প্রথমত চায় আল্লাহ যেন সন্তুষ্ট হন। কিন্তু সে এটাও চায় যে মানুষও তাঁর এই ভালো কাজ সম্পর্কে জানুক এবং তাকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখুক। এই সম্মান যেন রক্ষা পায় এবং কোনোভাবে নষ্ট না হয়, সে চেষ্টাও সে করতে তাকে। প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, এমন আকাঙ্ক্ষা নিষিদ্ধ, কেননা এতে বান্দার ইখলাস নষ্ট হয় এবং পরকালীন জীবনের ওপর পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অনন্তরে যে সীমা লঙ্ঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়, জাহান্নামই হবে তার আবাস।’

(সুরা : নাজিয়াত, আয়াত : ৩৭-৩৯)

২. অনুমোদিত আকাঙ্ক্ষা : যে মুমিন ইবাদত করার সময় এই নিয়ত করে যে পরকালে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং আল্লাহ তাঁকে বহু মানুষের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করবেন। তাঁর এই বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিষিদ্ধ নয়, বরং তা প্রশংসনীয়। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি সম্মান ও ক্ষমতা চায় সে জেনে রাখুক যাবতীয় সম্মান ও ক্ষমতা শুধু আল্লাহর জন্য।’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ১০)

যে খ্যাতি রহমতস্বরূপ

মহান আল্লাহ ভালোবেসে কিছু মানুষের প্রতি সৃষ্টিজগতের অন্তর ঝুঁকিয়ে দেন। ফলে তার মর্যাদা, সম্মান ও খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। এমন খ্যাতি আল্লাহর অনুগ্রহস্বরূপ। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, দয়াময় অবশ্যই তাদের জন্য সৃষ্টি করবেন ভালোবাসা।’

(সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ৯৬)

তাফসিরবিদরা বলেন, আল্লাহ এমন বান্দাকে ভালোবাসেন, তিনি তাদের অন্তরে আল্লাহ জন্য ভালোবাসা তৈরি করেন এবং তাদের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে দেন।

নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন জিবরিলকে ডেকে বলেন, অল্লাহ অমুককে ভালোবাসেন; অতএব তুমি তাকে ভালোবাসো। ফলে জিবরিল তাকে ভালোবাসেন। অতঃপর জিবরিল আসমানবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করেন, আল্লাহ অমুককে ভালোবাসেন, অতএব তোমরা তাকে ভালোবাসো। ফলে আসমানবাসীরা তাকে ভালোবাসে। তারপর জমিনে তার জনপ্রিয়তা রাখা হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৪০)

আত্মরক্ষার উপায়

মুমিনের জন্য খ্যাতির মোহ থেকে আত্মরক্ষা করা আবশ্যক। সুতরাং যেসব বিষয়ে খ্যাতির মোহ তৈরি হয় তা ত্যাগ করা জরুরি—যেমন মানুষের অতিরিক্ত প্রশংসা, তেমনি আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করা আবশ্যক। উমর (রা.) এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার সম্পর্কে ভালো জানেন আমার থেকেও এবং আমি নিজের সম্পর্কে বেশি জানি তাদের চেয়ে। হে আল্লাহ! তারা যে ধারণা পোষণ করে আমাকে তার কল্যাণ দান করুন। তারা যা জানে না সে ব্যাপারে আমাকে ক্ষমা করুন। তাদের কথার ব্যাপারে আমাকে পাকড়াও করবেন না।’

(আদাবুদ-দ্বিন ওয়াদ-দুনিয়া, পৃষ্ঠা-২৫১)

আল্লাহ সবাইকে খ্যাতির মোহ থেকে আত্মরক্ষা করার তাওফিক দিন। আমিন।

কিউএনবি/অনিমা/১০ ডিসেম্বর ২০২৫,/রাত ৯:৪১

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

December 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৬
IT & Technical Supported By:BiswaJit