আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে রোববার কঠোর সমালোচনা করেছে পাকিস্তান। দেশটি বলেছে—সন্ত্রাসবাদের মূল ইস্যু সমাধানের পরিবর্তে ইস্তাম্বুল শান্তি আলোচনা ব্যবহার করা হয়েছে পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণার জন্য।
তুরস্ক ও কাতারের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান-আফগান শান্তি আলোচনা ভেঙে পড়েছে, যদিও দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি এখনো বহাল রয়েছে। ৭ নভেম্বর প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জিও নিউজকে বলেন, ‘আলোচনা স্থগিত করা হয়েছে, চতুর্থ দফার কোনো কর্মসূচি নেই। সম্পূর্ণ অচলাবস্থা বিরাজ করছে, আলোচনার কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই।’
সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপে অনীহা
বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, যে কেউ আলোচনার ধারাবাহিকতা পর্যবেক্ষণ করেছেন, তিনি সহজেই বুঝতে পারবেন—তালেবান সরকার কেবল অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু আফগান মাটিতে অবস্থানরত সন্ত্রাসী উপাদানের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান বা যাচাইযোগ্য পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক।
তিনি আরও বলেন, ‘তালেবান আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করেছে এবং অকারণ বিতর্কে জড়িয়েছে যাতে কোনো বাস্তবসম্মত চুক্তিতে পৌঁছানো না যায়।’বিবৃতিতে ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার তীব্রতা বৃদ্ধির কথাও উল্লেখ করা হয়। তবুও পাকিস্তান, সামরিক ও বেসামরিক প্রাণহানির পরও, সংযম দেখিয়েছে এবং পাল্টা হামলা থেকে বিরত থেকেছে।
পাকিস্তানের প্রত্যাশা ছিল, তালেবান সরকার টিটিপি/এফএকে ও বিএলএ/এফএইচ গোষ্ঠীগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে।
মানবিক সহায়তা দিয়েও প্রতিদানহীন
বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তান আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে বাণিজ্যিক সুবিধা, মানবিক সহায়তা, শিক্ষা ও চিকিৎসা ভিসা প্রদানসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তালেবান সরকারের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
কিন্তু তালেবান সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল ‘শূন্য প্রতিশ্রুতি আর নিষ্ক্রিয়তা’।
‘আফগান ভূমি পাকিস্তানবিরোধী হামলায় ব্যবহার না হওয়ার যে প্রত্যাশা, তা কার্যকর করতে তালেবান সরকার কখনোই দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়নি। বরং তারা মূল ইস্যুটি আড়াল করতে তুচ্ছ ও কাল্পনিক বিষয়গুলো সামনে এনেছে,’ বিবৃতিতে বলা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অক্টোবর ২০২৫–এর আফগানিস্তানমুখী প্রতিক্রিয়াকে পাকিস্তানের জাতীয় দৃঢ়তার প্রতিফলন হিসেবে উল্লেখ করে জানায়, টিটিপি/এফএকে ও বিএলএ/এফএইচ রাষ্ট্র ও জনগণের ঘোষিত শত্রু।
তিন দফা আলোচনা, কিন্তু অগ্রগতি নেই
বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তান সর্বদা কূটনীতি ও শান্তির পক্ষে। তাই তুরস্ক ও কাতারের আন্তরিক পরামর্শে পাকিস্তান শান্তি আলোচনায় অংশ নেয়।
প্রথম দফার আলোচনা দোহায় অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উভয় পক্ষ কিছু মৌলিক সহযোগিতার নীতিতে সম্মত হয় এবং এর পর পাকিস্তান অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে।
দ্বিতীয় দফা আলোচনার লক্ষ্য ছিল দোহায় হওয়া অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের কাঠামো তৈরি করা। কিন্তু তালেবান প্রতিনিধিরা বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি; বরং উস্কানিমূলক অভিযোগ তুলে পরিবেশ উত্তপ্ত করে।
তৃতীয় দফায় পাকিস্তান গঠনমূলক মনোভাব নিয়ে আলোচনায় অংশ নিলেও আফগান পক্ষ মূল সন্ত্রাসবিরোধী ইস্যু থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে কল্পিত ও অমূলক দাবি উত্থাপন করে।
‘আফগান শরণার্থী নয়, সন্ত্রাসী’
বিবৃতিতে তালেবান প্রতিনিধিদের সেই বক্তব্যও প্রত্যাখ্যান করা হয়, যেখানে তারা পাকিস্তানি সন্ত্রাসীদের আফগানিস্তানে অবস্থানকে মানবিক বা শরণার্থী ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেছে। পাকিস্তানের মতে, এটি সন্ত্রাসীদের দায়মুক্তি দেওয়ার কৌশল।
পাকিস্তান জানিয়েছে, আফগানিস্তানে থাকা পাকিস্তানি নাগরিকদের তারা গ্রহণ করতে প্রস্তুত—তবে শর্ত হলো, তাদের নির্ধারিত সীমান্তপথ টরখাম বা চামান দিয়ে হস্তান্তর করতে হবে, অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় সীমান্ত অতিক্রম করতে দেওয়া যাবে না।
তালেবানের ভেতরে বিভাজন
বিবৃতিতে বলা হয়, তালেবান সরকারের ভেতরে এমন কিছু অংশ আছে যারা পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত চায় না; তবে বিদেশি প্রভাবিত একটি শক্তিশালী লবি পাকিস্তানবিরোধী উত্তেজনা উসকে দিচ্ছে।
‘নিজেদের সরকারকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে এবং বৈধতা অর্জনের লক্ষ্যে তালেবান প্রশাসনের কিছু অংশ, পাকিস্তানবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও তাদের মদতদাতারা পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণাকে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে,’ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
এই আচরণ পাকিস্তানে তাদের প্রতি বিদ্যমান সদিচ্ছা দ্রুত নষ্ট করছে বলেও সতর্ক করে পাকিস্তান।
পশতুন জাতীয়তাবাদ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তালেবান প্রশাসনের কিছু অংশ পাকিস্তানে পশতুন জাতীয়তাবাদ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্মরণ করিয়ে দেয়, পশতুনরা পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য ও প্রাণবন্ত অংশ। আফগান সরকারকে সীমান্তের ওপারে বিভেদ ছড়ানোর বদলে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে মনোযোগী হতে বলা হয়।
‘তালেবান যখন বলে সন্ত্রাসবাদ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, তারা উল্লেখ করে না যে আফগানিস্তানের অনেক ব্যক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জঙ্গি হামলার বৈধতা দিয়ে ফতোয়া জারি করেছে,’ বিবৃতিতে বলা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেষাংশে জানায়, পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পক্ষে, তবে সবার আগে আফগান ভূমি থেকে উদ্ভূত সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করতে হবে।
কিউএনবি/আয়শা/০৯ নভেম্বর ২০২৫,/রাত ১১:৩৩