ডেস্ক নিউজ : চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা যেন চাঁদাবাজ ও দখলবাজদের অভয়ারণ্য। বহুমুখী চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্যে অনেকেই হয়ে উঠেছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ। বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে বিভিন্ন আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীর নাম শোনা গেলেও ছাত্রজনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন করে নাম শোনা যাচ্ছে বিএনপি ও তার অংগ সংগঠনের বেশ কিছু নেতাকর্মীর। যার মধ্যে সাবেক পৌর যুবদলের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান সেলিম ওরফে মাই ওয়ান সেলিম অন্যতম।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও কিছুতেই থামছে না সেলিম মিজির এই চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্য। ফলে পুনরায় নতুন করে দেখা দিচ্ছে নানাবিধ নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতা। জানা যায়, বিগত ৫ আগষ্ট স্বৈরাচার পতনের পর কচুয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মাহাবুবের গাড়ি আটক করে মোটা অংকের টাকা চাঁদা আদায় করেন তিনি, যিনি ঢাকা বিমান বন্দরে আটক হয়ে বর্তমানে জেল হাজতে রয়েছেন।
দুই পক্ষের সম্পত্তি মামলা চলমান অবস্থায় হাজিগঞ্জ আমিন রোডে এক দাগের জমি ক্রয় করে, অন্য দাগে থাকা বনফুল সংঘ নামে একটি স্বনামধন্য ক্লাবের জায়গা দখলের চেষ্টা করেন তিনি। এমনকি তার পালিত বাহিনী দিয়ে মহড়া দেওয়া এবং ভয়-ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এবিষয়ে ক্লাবের আহবায়ক গোবিন্দ চন্দ্র সাহা বলেন- আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আইন যেভাবে আমাদের ক্লাবের জমি বুঝিয়ে দেবে আমরা সেভাবেই নেবো। আমরা আতংকিত, আমারা সেলিম গংদের হাত থেকে বাঁচতে চাই।’
এছাড়া রয়েল মার্কেট এর দোকান নিয়ে ২ পক্ষের বিবাদ এবং মামলা চলা অবস্থায় এক পক্ষকে দোকান জোরপূর্বক বুঝিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মোটা অংকের টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চিহ্নিত মাদকসেবী ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষে মাদক ব্যবসায়ীদের নির্বিঘ্নে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়ারও গুঞ্জন শোনা যায় লোকমুখে, যার মধ্যে নামকরা ইয়াবা ব্যবসায়ী শওকত অন্যতম।
এসব দখলে তিনি তার লালিত বাহিনী হাজীগঞ্জ উপজেলার সাবেক ছাত্রদলের আহবায়ক ফয়সাল হোসেন ও তার ছোট ভাই পৌর বিএনপির সাবেক ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক সাইফুল হাসানের নাম উঠে আসে। সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে জানা যায়, তারা দুই ভাই একটি মুদি দোকানে পেশি শক্তি ব্যবহার করে দোকানের কর্মচারীকে মারধর এবং মালিককে দোকান ছেড়ে দেয়ার হুমকিও প্রদান করে। নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে ছাত্রদলের নাম ভাঙানো কিছু ক্যাডার বাহিনী নিয়ে এলাকায় গড়ে তুলেছেন ত্রাসের রাজত্ব, সরকারি রেলওয়ের লিজকৃত পুকুরে ইজারা নিয়ে ঝামেলায় ভুক্তভুগি আমেনা বেগম নামে এক মহিলার পুকুরের মাছ ধরে নিয়ে যায় হাসান হুসেন নামে এই দুই ভাই।
পরে, আমেনা বেগম আইনের শরণাপন্ন তারা আমেনা বেগমের ছেলেদেরকে মেরে ফেলার হুমকী এবং ছেলেদেরকে ছাত্রলীগের তকমা লাগিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকিও প্রদান করে তারা। এছাড়াও ৫ ই আগস্টের পর পল্টন থানা ছাত্রলীগের সভাপতি তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আল আমিনকে নিজেদের শেলটারে বাড়িতে আশ্রয় দেয়ারও অভিযোগ পাওয়া যায় সেলিম গং এর এই লালিত ভাইদ্বয়ের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে গিয়ে এলাকার স্থানীয়দের সাথে কথা বলতে চাইলে সেলিমের ভয়ে কেউই প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়ে রাজি হয় না।
পরে গোপন ক্যামেরায় স্থানীয় কিছু ব্যক্তি মারফত জানা যায়, মাই ওয়ান সেলিম হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজারে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী দোষর জনৈক হীরা নামক এক ব্যক্তির জমির সাথে থাকা হিন্দুদের বেশ কয়েক শতক জমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দখল করিয়ে দেন। এছাড়াও চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্যে প্রতিটি জায়গায় তার এবং তার গ্যাং দের হাত রয়েছে এমনটাই এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়। এবিষয়ে ভুক্তভোগীরা বলেন- ‘সৈরাচার আওয়ামীলীগের সময় আমাদের এই জমিতে বিল্ডিং উঠাতে পারেনি কিন্তু ৫ ই আগষ্টের পর সেলিম ভাই নিজে দাড়িয়ে থেকে এখানে বিল্ডিং বানানোর কাজ শুরু করেন।’
এছাড়াও চোরাই পথে ভারত থেকে নিয়ে আসা বাংলাদেশে অনুমোদনহীন ৬৫০ সিসির একটি রয়েল এনফিল্ড মোটরবাইক কাগজপত্র ছাড়াই প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে নিজের ক্ষমতা জাহির করতে দাঁপিয়ে বেড়ান তিনি। আরও জানা যায়, নিজেকে বিএনপির ত্যাগী নেতা দাবী করে টোরাগড় দক্ষিণ পাড়ার ছোট রাজন, আরিয়ান সোহেল ওরফে টোকাই সোহেল , আমান ও বেশ কিছু উশৃঙ্খল বখাটে ছেলেসহ তার পালিত একটি বাহিনী দিয়ে মানুষকে ভয় ভীতি ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছেন প্রতিনিয়ত। যার মধ্যে কিশোর গ্যাং নেতা সোহেলকে পুলিশের হাতে আটক করা হয়েছে বলে জানা যায়।
শুধু তাই নয়, নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত দাবী করে বিভিন্ন জায়গায় অনৈতিক সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করেন তিনি। কিছুদিন আগে নিজের দোকান ভাঙচুর মামলার ভয় দেখিয়েও আসামিদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আরও জানা যায়, তার বিরুদ্ধে থানা ও সেনা ক্যাম্পে রয়েছে বেশ কিছু অভিযোগ, যার প্রেক্ষিতে আওয়ামী সরকারের পতনের পরও প্রায় তিন মাস পলাতক ছিলেন তিনি।
এছাড়াও গত বছরের সেপ্টেম্বরে এলাকায় সেলিম মিজি ও হাজী ইমাম হোসেনের আধিপত্য বিস্তর করাকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনায় নিহত হয় একজন। যা নিয়ে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বহু সংবাদ প্রকাশিত হয়। ফলে বিএনপি’র নীতি নির্ধারকরা সাবেক আহ্বায়ক হাজী ইমাম হোসেন কে বহিষ্কার করলেও অদৃশ্য কোন এক শক্তির জোড়ে বহাল তবিয়তে নিজের পদ দখলে রেখে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। ফলে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে।
ফুটপাতসহ বেশ কিছু জায়গায় চাঁদাবাজি কমলেও বিএনপি’র এসব নামধারী নেতা প্রতিনিয়ত করে চলছে প্রকাশ্য চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্য । আর এভাবেই প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষুণ্ণ করছে জাতিয়তাবাদী দল বিএনপির সুনাম ও ভাবমূর্তি। অভিযোগের বিষয়ে তার শোরুমে গিয়ে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি হাসান হুসেনসহ অন্তত ২০/২৫ জনের একদল লোক নিয়ে মব সৃষ্টি করে ভয়ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করেন। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বলেন- ‘আমি মানুষের টাকা কেন আত্মসাৎ করব, এছাড়া জমি দখলেরতো আমার কোন প্রয়োজন নেই। আমার বাবার যে সম্পত্তি আছে তা হেটে শেষ করতে আপনাদের কমপক্ষে তিনদিন সময় লাগবে। আমি সামনে হাজীগঞ্জ উপজেলা মেয়র নির্বাচন করব। তাই হয়তো আমার প্রতিপক্ষরা আমার নামে বিভিন্ন কুৎসা রটাচ্ছে।’
এ বিষয়ে হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ এর সাথে কথা বলে জানা যায়- ‘৫ই আগষ্টের পরে তার বাসায় অস্ত্রের অভিযোগে বেশ কয়েকবার সেনাবাহিনীসহ আমরা তল্লাশি চালিয়েছি- তবে তার বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও আপাতত কোন অভিযোগ নেই।’আমরা সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি, চাঁদপুর-৫ ধানের শীষের মনোনয়ন প্রত্যাশী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ইন্জিনিয়ার মমিনুল হক সবরকম চাঁদাবাজ ও দখলবাজদের বিরুদ্ধে বারবার বিভিন্ন প্রোগ্রামে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।তারপরেও কিভাবে এই সেলিম ও হাসান-হোসেনরা দখল বাণিজ্য করে বেড়াচ্ছেন ?
বিএনপির নীতি নির্ধারকরা এসব চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব বন্ধে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থা গ্রহন করলেও কিছুতেই যেন থামছেনা এসব চাঁদাবাজী ও দখল বাণিজ্য। অনিয়ম ও দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচিত হওয়ায় প্রতিনিয়ত দলীয় পদ হাড়ানোসহ দল থেকে বহিষ্কার হচ্ছে নেতাকর্মীরা। তবুও কিছুতেই টেনে ধরা যাচ্ছেনা এই অসাধুচক্রের লাগাম। সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনসাধারণের আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতন হলেও কিছুতেই যেন থামছেনা এসব চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও জ্বালাওপোড়াওয়ের মতো নৈরাজ্য। বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ আশার বাণী শোনালেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাস্তবতা যেন আগের মতই এক ও অভিন্ন। তাই সাধারণ মানুষের প্রশ্ন তবে কি আওয়ামী সরকারের পথেই হাঁটছে বিএনপি? নাকি আওয়ামীলীগ ও বিএনপি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে???
কিউএনবি/আয়শা/০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, /দুপুর ২:৫০