শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:০২ পূর্বাহ্ন

‎লালমনিরহাটে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী “গরুর গাড়ি”

জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট প্রতিনিধি ।
  • Update Time : বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৫
  • ৯৬ Time View

‎জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, ‎‎লালমনিরহাট প্রতিনিধি : ‎উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটসহ সারাদেশেই এক সময়ের জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী পরিবহন মাধ্যম গরুর গাড়ি এখন বিলুপ্তির পথে। নতুন প্রযুক্তি ও যান্ত্রিক বাহনের সহজলভ্যতায় হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার এই অমূল্য ঐতিহ্য। ‎একসময় গ্রামীণ জনপদের আঁকাবাঁকা মেঠোপথে কৃষিপণ্য বহন, বরযাত্রী আনা-নেওয়া কিংবা দৈনন্দিন কাজে গরুর গাড়ির বিকল্প ছিল না।

‎”গরু বা মহিষের গাড়ি” দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা বলদে বা মহিষে টানা এক প্রকার বিশেষ যান। এ যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সাথে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। গাড়ির সামনের দিকে একটি জোয়ালের সাথে দুটি গরু বা বলদ জুটি মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে। সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। আর পেছনে বসেন যাত্রীরা। বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হয় গাড়ির পেছন দিকে। বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল ব্যাপক।

‎সীমান্ত ঘেষা উত্তরাঞ্চলে গ্রামবাংলার এক সময়ের জনপ্রিয় গরুর গাড়ি বর্তমানে রুপকথার গল্প। সভ্যতার প্রায় উন্মেষকাল থেকেই বাংলাদেশের সবর্ত্রই যাতায়াত ও পরিবহনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ  যান ছিল ‘গরুর গাড়ি’। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার বিবর্তনে যন্ত্র ও ব্যাটারিচালিত নানা যন্ত্রযানের উদ্ভবের ফলে বিলুপ্তি প্রায় ‘গরুর গাড়ি’। ‎লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের ৮০ বছর বয়সী রমজান আলী স্মৃতিচারণ করে বলেন, “দুই যুগ আগেও বিয়ে মানেই ছিল গরুর গাড়ি। বরযাত্রী, মালামাল—সব কিছু গরুর গাড়িতেই হতো। গরুর গাড়ি ছাড়া বিয়ে কল্পনাই করা যেত না।”

‎গরুর গাড়িকে ঘিরেই রচিত হয়েছে অসংখ্য ভাওয়াইয়া গান। জনপ্রিয় গান ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ কিংবা ‘আস্তে বোলাও গাড়ি’ গ্রামীণ মানুষের স্মৃতিকে এখনো উজ্জীবিত করে। কিন্তু বাস্তব জীবনে গরুর গাড়ি এখন আর চোখে পড়ে না। ‎কৃষকেরা একসময় ফজরের আগে গরুর গাড়িতে করে মাঠে যেতেন—কখনো জৈব সার, কখনো লাঙ্গল বা মই নিয়ে। আবার কৃষিজাত পণ্য বাজারজাত করতেও গরুর গাড়ির বিকল্প ছিল না। অথচ আজ সেই গরুর গাড়ির শব্দই হারিয়ে গেছে গ্রামবাংলা থেকে।

‎গরুর গাড়ির বিশেষত্ব ছিল এটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। এতে কোনো জ্বালানি বা ধোঁয়া ছিল না, দুর্ঘটনার আশঙ্কাও ছিল সামান্য। অথচ যান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রগতির ফলে আজ এটি বিলুপ্তির পথে। ‎রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও সংস্কৃতি গবেষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “গরুর গাড়ি কেবল একটি বাহন নয়, এটি ছিল আমাদের লোকজ সংস্কৃতির প্রতীক। ভাওয়াইয়া গান থেকে শুরু করে বিয়ের সামাজিক আয়োজন—সবকিছুর সাথেই মিশে ছিল গরুর গাড়ি। এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে। এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে অন্তত প্রতিটি জেলা শহরে প্রতীকী গরুর গাড়ি সংরক্ষণ বা প্রদর্শনী করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।”

‎লালমনিরহাহাট জেলা জৈষ্ঠ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কানু বলেন, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি প্রকৃতিবান্ধব গরুর গাড়ি বহুবিধ কারণে বর্তমানে হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও কালেভদ্রে দু-একটি গরুর গাড়ির দেখা মিললেও বর্তমানে তা ডুমুরের ফুল। ঐতিহ্যের স্বার্থেই এ বিষয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ‎স্থানীয়রা বলছেন, সময়ের বিবর্তনে হয়তো গরুর গাড়ি আর ব্যবহারিক বাহন হিসেবে ফিরবে না। তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এটি শুধু বইয়ের পাতায় বা জাদুঘরে নয়, বাস্তব ঐতিহ্য হিসেবে টিকে থাক—এমন প্রত্যাশাই সবার।

 

 

কিউএনবি/আয়শা/২৭ আগস্ট ২০২৫/রাত ১০:৫০

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

December 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৬
IT & Technical Supported By:BiswaJit