আন্তর্জাতিক ডেস্ক : অ্যান্টার্কটিকার অসীম বরফের রাজ্যে বরাবরই রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। এবার সেই রহস্যের আরেকটি পর্দা সরাতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। প্রায় ৫০ কোটি বছর ধরে বরফের নিচে চাপা পড়ে থাকা গ্যাম্বুরতসেভ পর্বতমালা নিয়ে নতুন গবেষণায় মিলেছে চমকপ্রদ তথ্য।
অ্যান্টার্কটিকার গহীনে এই পর্বতশ্রেণিটি অবস্থান করছে বরফের কয়েক কিলোমিটার গভীরে। আকারে এটি ইউরোপের আল্পস পর্বতের মতো হলেও বরফের চাপে এতটাই সুনিপুণভাবে সংরক্ষিত আছে যে, এটি বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে অক্ষত অবস্থায় থাকা পর্বত বলয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গ্যাম্বুরতসেভ পর্বতমালা প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৫৮ সালে, একটি আন্তর্জাতিক অভিযানে ভূকম্পন কৌশল ব্যবহার করে। এরপর থেকে এর গঠন, অবস্থান ও বিকাশ নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহল ক্রমেই বেড়েছে। এর অবস্থান পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার সবচেয়ে উঁচু বরফস্তরের নিচে। এই বরফচাদর দীর্ঘ সময় ধরে পর্বতটিকে প্রাকৃতিক ক্ষয় ও টেকটোনিক বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করেছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর অধিকাংশ পর্বতশ্রেণি সময়ের সাথে সাথে ক্ষয়ে যায় বা ভূ-ত্বকের সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে। কিন্তু গ্যাম্বুরতসেভ পর্বতমালা বরফের নিচে থাকার কারণে প্রায় অপরিবর্তিত রূপে টিকে গেছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রায় ৫৮ কোটি বছর আগে গন্ডোয়ানা নামের বিশাল সুপার মহাদেশে টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষে এই পর্বতশ্রেণির জন্ম হয়। সেই সংঘর্ষের সময় প্রচণ্ড তাপ ও গলিত শিলার প্রবাহ শুরু হয় যা পর্বত গঠনে সহায়তা করে। ভূত্বক ঘন হয়ে ওঠে, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু অংশ নিজের ওজনেই ভেঙে পড়ে।
এই পর্বতের বিকাশ, স্থিতিশীলতা ও গঠন বিশ্লেষণে সাহায্য করছে এক বিশেষ খনিজ—জিরকন। ক্ষুদ্র এই স্ফটিক খনিজকে ভূতাত্ত্বিক স্টপওয়াচ বলা হয়। এটি কোটি কোটি বছর ধরে টিকে থাকতে পারে এবং ইউরেনিয়াম ধারণ করতে সক্ষম। ইউরেনিয়ামের ক্ষয় থেকে বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত নির্ভুলভাবে শিলার বয়স নির্ধারণ করতে পারেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্যাম্বুরতসেভ পর্বতমালার শিলায় থাকা জিরকনের তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, প্রায় ৫৮ কোটি বছর আগে এই পর্বতশ্রেণি গঠিত হয়েছিল এবং ৫০ কোটি বছর আগে সেখানে কাঠামোগত পরিবর্তন শুরু হয়।
গবেষণা দলের সদস্য জেফ বেনোভিটজ বলেন, অ্যান্টার্কটিকার বরফের চাদর ভূতাত্ত্বিক অনেক তথ্য আড়াল করে রেখেছে। ট্রান্স-অ্যান্টার্কটিকার বেসমেন্ট শিলা বিশ্লেষণ আমাদের বরফের নিচে থাকা ভূপ্রকৃতির ইতিহাস বুঝতে সাহায্য করছে।
এই গবেষণার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, বরফের মধ্য দিয়ে খনন করে শিলার নমুনা সংগ্রহ করা। তবে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে সেই পথও এখন সহজ হচ্ছে। নতুন কিছু মডেলের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা খনিজ উপস্থিতির দিকটি বিশ্লেষণ করছেন, যা ভবিষ্যতের গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করবে।
‘আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্স লেটারস’ নামক জার্নালে এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই পর্বতের রহস্য আরও গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারলে পৃথিবীর প্রাচীন ভূ-তাত্ত্বিক ইতিহাস আরও পরিষ্কার হবে। এবং এই অদ্ভুতভাবে সংরক্ষিত গ্যাম্বুরতসেভ পর্বতমালা বিশ্ববিজ্ঞানের জন্য এক অসাধারণ জানালার দ্বার খুলে দেবে।
কিউএনবি/অনিমা/০৭ জুন ২০২৫, /দুপুর ১২:৩৭