পাহাড় থেকে অবৈধ সিগারেট পাচারের নতুন রুট রাজস্থলী,কাপ্তাই-রাঙ্গুনিয়া,কুতুকছড়ি-মহালছড়ি সড়ক
Reporter Name
Update Time :
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০২৫
৪২
Time View
আলমগীর মানিক,রাঙামাটি : রাঙামাটির প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত সীমান্ত হয়ে পাহাড়ের দূর্গম বনাঞ্চল দিয়ে অবৈধ পথে শুল্কবিহীন কোটি টাকার সিগারেট নানান ছদ্মবেশে পাচার করছে চোরাকারবারিরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সীমান্তরক্ষি বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় রাঙামাটি শহর হয়ে বর্তমানে অবৈধ সিগারেট পাচার প্রক্রিয়া কমিয়ে দিয়ে নতুন রুট হিসেবে, জুড়াছড়ি-বিলাইছড়ি-রাজস্থলী হয়ে বাঙ্গালহালিয়া-রাঙ্গুনিয়া, রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের নানিয়ারচরের বুড়িঘাট মহালছড়ি এবং রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের আসামবস্তির বড়াদম হয়ে মানিকছড়ির দেপ্পোছড়ি ও ওয়া¹ার পাহাড়ি পথ হয়ে কাপ্তাই-চট্টগ্রাম সড়ক দিয়ে অটোরিক্সা ও কাভার্ড ভ্যানে করে অবৈধ সিগারেট পাচার করছে চোরাচালানি সিন্ডিকেট চক্র। অবশেষে বিষয়টি স্থানীয় সোর্সের মাধ্যমে অবহিত হয়ে শুক্রবার সকালে বিশেষ চেকপোষ্ট বসিয়ে প্রায় ১৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা মূল্যের অবৈধ সিগারেটসহ দুই ব্যক্তিকে আটক করেছে রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশ কর্তৃপক্ষ।
আটককৃতরা হলো, রাঙামাটি শহরের স্বর্ণটিলার বাসিন্দা অটোরিক্সা চালক ওমর ফারুক, সে লংগদু উপজেলার বগাচত্বর ইউনিয়নের বৈরাগি বাজার সেলিম মিয়ার বাড়ির মৃত আবুল হোসেনের সন্তান। আরেকজন লোহাগাড়া উপজেলার ২নং দক্ষিণ পুটিয়াবিলা ইউনিয়নের বড়–য়া পাড়ার বাসিন্দা দিপংকর বড়ুয়া।রাঙ্গুনিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ সাব্বির মোহাম্মদ সেলিম মুঠোফোনে প্রতিবেদককে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, অবৈধভাবে আনা বিদেশী সিগারেট পাচার হবে এমন তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার সকাল ৯ টার দিকে আমি আমার সঙ্গীয় ফোর্সদের সাথে নিয়ে রাঙ্গুনিয়া পৌর সদরের সাহাগ কমিউনিটি সেন্টারের সামনে কাপ্তাই সড়কের উপর বিশেষ চেকপোষ্ট বসিয়ে তল্লাসী চালানো শুরু করি।এক পর্যায়ে বস্তাভর্তি মাল নিয়ে একটি অটোরিক্সা (রাঙামাটি-থ-১১-০৭৪০) দ্রুতগতিতে চালিয়ে যাওয়ার সময় আমরা সেটিতে গতিরোধ করে আটকাই। পরবর্তীতে অটোরিক্সায় থাকা দুই ব্যক্তিকে হেফাজতে নিয়ে বস্তাগুলো খুলে বিদেশী সিগারেট পাওয়া যায়। যার মধ্যে ৯ লাখ ৭৯ হাজার টাকা বাজার মূল্যের পেট্টোন এবং ৫ লক্ষ ৮৯ হাজার ৯শ টাকা মূল্যের অরিস ব্যান্ডের সিগারেট রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ওসি জানান, এই ঘটনায় রাঙ্গুনিয়া থানার এসআই রাজীব তালুকদার বাদি হয়ে আটককৃতদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ২৫(বি) ধারায় মামলা দায়ের করেছেন। যার মামলা নাম্বার-১০, তারিখ: ১৭/০১/২০২৫ ইং।জানাগেছে, রাঙ্গুনিয়ায় যে সিগারেটগুলো আটক হয়েছে সেগুলো রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারের জনৈক হেলালের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছিলো দিপংকর ও ফারুক। একটি সূত্র জানিয়েছে সিএনজি ড্রাইভার ফারুক হেলালের ঘনিষ্ট্য বন্ধ এবং দিপংকর বড়ুয়া ও হেলালের বাড়ি একই এলাকায়, তার মোবাইল: ০১৮৭৪…….০৪, ০১৮৭৪…….৩০৪।
বিশস্থ সূত্রে জানাগেছে, রাঙামাটিতে এই চক্রের প্রায় ২৫জন সদস্য সক্রিয় রয়েছে এই চোরা-চালানকান্ডে। চোরাকারবারি এই সিন্ডিকেট চক্র ভারতীয় সিগারেটসহ বিভিন্ন ধরনের ভারতীয় জিনিসপত্র চট্টগ্রাম পাচারের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। রাঙামাটির সংশ্লিষ্ট সকলকে ম্যানেজ করেই তারা এসব অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছেন। সম্প্রতি এই সিন্ডিকেট চক্র থেকে রাঙামাটি শহরে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে এবং নিরাপদে অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে নিতে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এই চক্রটি এখন স্থানীয় উপজাতীয় সম্প্রদায়ের অন্তত ৬ জন ব্যবসায়িকে তাদের গ্রুপে অর্ন্তভূক্ত করে তাদের মাধ্যমে দূর্গম পাহাড়ি পথ ব্যবহার করে পাহাড়ি গ্রামের মধ্যদিয়ে সিগারেটের কার্টুনগুলো স্বল্প খরছে রাঙামাটি চট্টগ্রাম সড়কে, কাপ্তাই-চট্টগ্রাম রুট এবং কুতুকছড়ি, নানিয়ারচর-মহালছড়ি রুট ব্যবহার করে সিগারেট পাচার করছে। এছাড়াও ভারতীয় সীমান্ত হয়ে জুড়াছড়ি-বিলাইছড়ির সীমান্ত সড়ক দিয়ে জীপ গাড়িতে করে রাজস্থলী-বাঙ্গালহালিয়া হয়ে রাঙ্গুনিয়া দিয়ে চট্টগ্রামে সিগারেট পাচার করছে সিন্ডিকেট চক্র।
নিরাপত্তাবাহিনীর একটি সূত্র ও স্থানীয় সংশ্লিষ্ট্যদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, বৃহস্পতিবার আটককৃত সিগারেটগুলোর মূল মালিক সুমিত্র চাকমা নামের এক ব্যক্তি। পরেশ চাকমা, পুলক্ক চাকমা ওরফে বিকাশ, বিশ্বজিৎ চাকমা, অমর চাকমা, রুপম চাকমা (সিকো), জুয়েল চাকমা, কালামন চাকমা, ত্রিরাজা চাকমা নামের এসকল ব্যক্তি এই সিগারেট ব্যবসার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলার সীমান্ত এলাকায় ভারত থেকে এসকল সিগারেট অবৈধভাবে রাঙামাটিতে নিয়ে আসে। এগুলো আনার সময় এবং রাঙামাটি থেকে পাচারে বিভিন্ন মাধ্যমকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব পালন করে রাজু বড়ুয়া নামের এক ব্যক্তি। এই সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করে মঈনউদ্দিন নামের একজন। যে সম্প্রতি আরেক ব্যবসায়ির ৪০ লাখ টাকা মেরে আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানা গেছে। তার বাড়ি রাঙামাটিতে হলেও তিনি প্রায় সময় চট্টগ্রাম অবস্থান করেন।
সংশ্লিষ্ট্যদের সাথে ছদ্মবেশি ক্রেতা সেজে আলাপকালে তারা জানায়, চট্টগ্রামের ৫ জনের সিন্ডিকেট চক্র এই সিগারেট ব্যবসার নিয়ন্ত্রক। তাদের কয়েকজনের ছবিও হাতে এসেছে প্রতিবেদকের নিকট। চট্টগ্রামের রাশেদ মোবাইলÑ০১৬০………৫২১, কামরুল-মোবাইল: ০১৮৫৮……২৭, মোর্শেদসহ আরো কয়েকজন বড় বড় চোরাকারিদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে তাদের মাধ্যমে এসকল সিগারেট সংগ্রহ করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছে বলে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।চট্টগ্রামের জনৈক ব্যক্তি…..হাসান, যার রবি মুঠোফোনের নাম্বার-০১৮১১………..৪৭। এই ব্যক্তি রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, টেকনাফ, ফেনী, কুমিল্লা ছাগলনাইয়া সীমান্ত দিয়ে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে সংশ্লিষ্ট্য সকল পক্ষকে ম্যানেজ করে অবৈধ সিগারেটের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছে। তার মাধ্যমেই বিগত বছরে তৎকালীণ ক্ষমতাসীনদের একটি চক্র শুধুমাত্র রাঙামাটি রুটেই প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা চাঁদা আদায় করতো। ক্ষমতার পালাবদলের পর নতুন পাহাড়াদারদের মাধ্যমে দ্বিগুণ হারে চাঁদা দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছেন সিগারেট ব্যবসা।সিগারেট ব্যবসার সাথে জড়িত অন্তত তিন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে জানায়, ভাই আমরা এক কোটি টাকার সিগারেট প্রায় আড়াই কোটি টাকায় বিক্রি করি। কিন্তু স্থানীয় কয়েকটি চক্রকে বিপুল পরিমাণ চাঁদা পরিশোধ করতে হয় আমাদের।
জানাগেছে, সম্প্রতি এই অবৈধ সিগারেটের ব্যবসায় অন্তত ১০ কোটি টাকা অর্থ বিনিয়োগ করেছে উপজাতীয়দের বৃহৎ একটি আঞ্চলিক দলের কয়েকজন কালেক্টর। সম্প্রতি এই কালেক্টরদের একজনের বোনের প্রায় ৬০ লাখ টাকার সিগারেট রাঙামাটি শহরে সাওতাল পাহাড় সংলগ্ন কাপ্তাই হ্রদের বোট থেকে জনৈক ছাত্রনেতার নেতৃত্বে লুট করে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন পর্যায়ের চাপে ৩০ লাখ টাকা ফেরৎ দিয়েছে বলে জানাগেছে। এছাড়াও নুর মোহাম্মদ নামের আরেক ব্যবসায়ির কাছ থেকে যুব নেতার নেতৃত্বে সাড়ে ১৩ লাখ টাকার সিগারেট প্রকাশ্য দিবালোকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর শৃঙ্খলাবাহিনী উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ও বিভাগীয় নেতার নির্দেশের পরও লুট করা সিগারেট ফেরৎ দেয়নি।একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, একটি দলের প্রথমসারির এক নেতার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে চিহ্নিত অপকর্মকারিরা। এই গ্রুপের সন্ত্রাসীরা শহরের রিজার্ভ বাজারের একাধিক ব্যবসায়ির কাছ থেকেও রাতের আধারে আদায় করেছে লাখ টাকার চাঁদা। জায়গা-জমির বিরোধ থেকে শুরু করে যেকোনো ব্যক্তিগত ঝামেলায় এই চক্রটি গায়েপড়ে জোরপূর্বক বিচারের রায় চাপিয়ে দিয়ে লাখ-লাখ টাকা আদায় করছে।
সূত্র জানায়, মুদি ব্যবসায়ি, ফেরিওয়ালা, কাপড়ের দোকানদার, সি-গারেট কোম্পানীর এসআর, সেলসম্যান, যুব নেতা-কর্মী, ছাত্র-যুবনেতা, কসমেটিক দোকানদার-ফেরিওয়ালা, কাঁচামাল ব্যবসায়ি, ঝাঁড়ুফুল ব্যবসায়ি, বিস্কুটের এজেন্ট, মৎস্য ব্যবসায়ি, তেল বেয়ারি, গরু বেপারির ছদ্মাবরনে অবৈধ সিগারেটের ব্যবসা চলছে। এই সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্য রাঙামাটি থেকে হরিণা বাজারে এবং জুরাছড়ির যক্ষাবাজারে ফরিয়া ব্যবসায়ির ছদ্মবেশে গিয়ে সেখানকার পাহাড়ি সিন্ডিকেট চক্রের সাথে কন্ট্রাক করে অবৈভাবে শুল্কবিহীনভাবে আনা বিদেশী সিগারেট সংগ্রহ করে।এদিকে রাঙামাটি কোতয়ালী থানা সূত্রে জানাগেছে, সাম্প্রতিক সময়ে তারা সিগারেট আটকের মামলায় জুয়েল ও শফি নামের দুই ব্যক্তিকে সিগারেটসহ গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেলে প্রেরণ করেছে। এছাড়া এই অবৈধ চোরাচালান কার্যক্রমের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশ।