ডেস্ক নিউজ : দশমী তিথিতে দেবী আবার পাড়ি দেবেন কৈলাসে। এই দিনেই মা দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় এবং শুরু হয় আবার এক বছরের অপেক্ষার পালা। ‘দশমী’ মানেই ঘরের মেয়ে অর্থাৎ উমার বিদায় বেলা। পিতৃগৃহ ছেড়ে উমা এবার ফিরে যাবেন কৈলাসে স্বামী মহাদেবের কাছে। তাই মর্ত্যবাসীর মন খারাপ। দুর্গাপূজার এই শেষদিনটিকে দশমী বা বিজয়া দশমী বলা হয়ে থাকে। কেন দশমীকে বিজয়া দশমী বলা হয়, তা এখন জেনে নেব আমরা।
মহিষাসুর নামে এক অসুর ব্রহ্মার বর পেয়ে প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে নেন। তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে স্বর্গ থেকে বিচ্যুত করেন। ব্রহ্মা তাকে বর দিয়েছিলেন, কোনো পুরুষ তাকে হত্যা করতে পারবে না। তবে কোনো নারী তাকে বধ করতে পারবে না এমন বর দেওয়া হয়নি। তখন সব দেবতার সম্মিলিত শক্তি থেকে আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। পুরাণে মহিষাসুর বধের কাহিনি অনুসারে টানা নয় দিন ও নয় রাত যুদ্ধের পর শুক্লা দশমীতে দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন। এই বিজয় লাভকেই বিজয়া দশমী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ত্রেতা যুগে লংকার রাজা রাবণ শ্রীরামচন্দ্রের পত্নী সীতাকে অপহরণ করেছিলেন। দেবী দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে রাম স্ত্রীকে উদ্ধার করতে লংকা আক্রমণ করেন। শুক্লা দশমীতেই তিনি রাবণকে বধ করেন। রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রামের জয়লাভকেও চিহ্নিত করে বিজয়া দশমী। উত্তর ও মধ্য ভারতে এই দিনে দশেরা উদযাপিত হয়। তবে এর তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘দশহর’ থেকে, যার অর্থ দশানন রাবণের মৃত্যু। বাল্মীকি রামায়ণে বলা হয়েছে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করেছিলেন রাম। কালিদাসের রঘুবংশ তুলসীদাস রামচরিত মানস সূত্রের সঙ্গে সংযোগ রেখেই বলা হয়েছে, রাবণ বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা, লক্ষণ। রামচন্দ্রের প্রত্যাবর্তনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে। দশেরা অর্থাৎ নবরাত্রি, এর প্রথম নয় দিন মা দুর্গাকে পূজা করা হয় নানাভাবে। নবরাত্রি মানে নয়টি রাত্রি, যা নয়টি গ্রহের পরিচালনায় ঠিকমতো চালিত করতে পারে। শুধু দুর্গাপূজার বাহ্যিক আড়ম্বরই নয়, অন্তর থেকে দেবীকে পূজা করে প্রতিটি গ্রহের প্রভাবে যেন ঠিকভাবে শরীর চালিত হয়, সেই প্রার্থনা করা। বিজয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে জ্ঞানার্জন। এই শুভদিনে ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, পণ্ডিত-মূর্খ, উঁচু-নীচু বিচার না করে সবাই একাত্মবোধে আবদ্ধ হয়। সব ক্ষুদ্রতা ও পাশবিক বৃত্তির অবসান ঘটিয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সহাবস্থানের ভাবনা জাগ্রত করে মানবকল্যাণে ব্রতী হওয়ার সাধনাই হচ্ছে মায়ের বিজয়া দশমীর বিসর্জন পর্ব। দশমীর সকালে এক কৌটা সিঁদুর নিয়ে মায়ের মন্দিরে যাওয়া এবং সেই সিঁদুর থেকে কিছুটা মায়ের চরণে অর্পণ করা, বাকিটা বাড়ি নিয়ে চলে আসা। সেই সিঁদুর সারা বছর পুরুষ, নারী নির্বিশেষে ব্যবহার করে বিপদ দূর করার শক্তি হিসাবে। বিজয়া দশমীর দিন সকালে রাম মন্দিরে যাওয়া এবং সেখানে গিয়ে একটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো। দশমী পূজার অঞ্জলি দেওয়ার সময় সাদা বা নীল অপরাজিতা ফুল অর্পণ করা। শক্তির আরাধনা চলতে থাকে। অতঃপর দশম দিনে মাকে বিশেষভাবে সম্মান জানানো হয়। তারপর মাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। ‘আসছে বছর আবার এসো’-এই বলে তাকে আবাহন জানানো হয়। শুরু হয় সব বিভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করে মিষ্টিমুখ করা। বিজয়া দশমীতে আমাদের প্রার্থনা-সবাই যেন একসঙ্গে শান্তি, সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করতে পারি।
রূপম চক্রবর্ত্তী : সনাতন ধর্মীয় বক্তা, প্রাবন্ধিক
কিউএনবি/অনিমা/১৪ অক্টোবর ২০২৪,/সকাল ১১:০৭