মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ০৯:১৭ পূর্বাহ্ন

লোক দেখানো কোরবানি নয়

Reporter Name
  • Update Time : শনিবার, ১৫ জুন, ২০২৪
  • ১৩০ Time View

ডেস্ক নিউজ : কোরবানি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও মহিমান্বিত ইবাদত। ত্যাগ, নিষ্ঠা, প্রেম ও ভালোবাসার স্মারক। শর্তহীন আনুগত্যের আলোকবর্তিকা, অনুপম আদর্শ। সামর্থ্যবান মুমিন বান্দারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় তাদের কোরবানির পশু দয়াময় আল্লাহর নামে জবেহ করবে এবং মহান প্রভুর উন্মুক্ত আপ্যায়ন গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করবে।

তাওহিদের ধর্ম ইসলাম। কোনো একটি আমল মহান মালিকের দরবারে কবুল হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত, ইখলাসের (একনিষ্ঠতার) সঙ্গে হওয়া এবং শিরকমুক্ত হওয়া। ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং যে কেউ নিজ রবের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং নিজ প্রতিপালকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক না করে।’ -সুরা কাহাফ : ১১০

শিরকের রয়েছে নানান রূপ এবং প্রকৃতি। রিয়া বা লোক দেখানোও এক প্রকার শিরক, যাকে ‘শিরকে আসগর’ বা ছোট শিরক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমন আরও অনেক ছোট ছোট শিরক মিশে আছে আমাদের বিভিন্ন আচরণ-উচ্চারণে। মুমিনের দায়িত্ব, হক্কানি আলেমদের থেকে এ সব শিরকের বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা এবং সেগুলো থেকে বেঁচে থাকা।

ইবাদতের আরেক বৈশিষ্ট্য ইহসান। সদা-সর্বদা আল্লাহর জিকির ও স্মরণ হৃদয়ে জাগ্রত থাকা। হাদিসের ভাষায়, ‘আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করা, যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ। তা যদি সম্ভব না হয়, তো এতটুকু অনুভূতি হৃদয়ে অবশ্যই জাগ্রত রাখ যে, আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।’ -সহিহ বোখারি : ৫০

মুমিনের ইবাদত আল্লাহর দরবারে গৃহীত হওয়ার আরেকটি শর্ত, ইবাদতটি সুন্নাহসম্মত পন্থায় হওয়া। হজরত রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ইবাদত যে পদ্ধতিতে আদায় করেছেন এবং সাহাবিদের শিখিয়েছেন সেই পদ্ধতিতেই ইবাদতটি সম্পন্ন হওয়া। মোটকথা, ইখলাস, ইহসান ও সুন্নাহসম্মত ইবাদতই কেবল প্রাণবন্ত ইবাদত। বলাবাহুল্য, ইবাদতের উপরোক্ত শর্ত এবং বৈশিষ্ট্যসমূহ কোরবানির আমলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাম্য।

আফসোস, বর্তমানে এই কোরবানিকে ঘিরে ইখলাস ও ইহসান পরিপন্থী, রিয়া ও লৌকিকতাসূলভ নানান জিনিসের বিস্তার ঘটছে সমাজে। একসময় ছিল, কেবল পশুর গলায় সুন্দর সুন্দর মালা পরানো হত এবং লোকের ঈর্ষাকাতর দৃষ্টি কামনা করা হত। তারপর আরেকটু অগ্রসর হলো- নামি-দামি হাঁটের সেরা পশুটি কিনে প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ঢাকঢোল পেটানো এবং লোকের ‘বাহবা’ কুড়ানো! এখন অবস্থা আরও শোচনীয়, পশুকে স্পর্শ করে তার ছবি, ভিডিও কিংবা সেলফি তোলা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা।

এমনকি নিরীহ পশুটির একদম কাঁধে চড়ে ছবি তোলার মতো অমানবিক দৃশ্যও নজরে পড়ে! আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, পশু জবাইয়ের সময় আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠা এবং জবাইয়ের ছবি-ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা! যা কখনও কখনও অমুসলিমদের জন্য ভুল বুঝাবুঝিরও কারণ হতে পারে।

আমাদের ভেবে দেখা উচিত, এসব আচরণের দ্বারা নিজের ইবাদত-বন্দেগিটা বিনোদনে পরিণত করা হয়ে গেল কি না? বা ইবাদতটা হাস্যরস ও ক্রীড়া-কৌতুকে পর্যবসিত হয়ে গেল কি না? অথচ পবিত্র কোরআন ইবাদতকে বিনোদনে পরিণত করা কাফের এবং জাহান্নামীদের স্বভাব বলে চিহ্নিত করেছে। কোরআনে কারিমের ভাষায়, ‘যারা নিজেদের দ্বীনকে তামাশা এবং ক্রীড়া-কৌতুকরূপে গ্রহণ করেছিল এবং পার্থিব জীবন ওদের ধোঁকায় ফেলেছিল। সুতরাং আজ আমি তাদেরকে ভুলে যাব যেভাবে তারা এই দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল।’ -সুরা আরাফ : ৫১

কাজেই মুমিনের জন্য কখনও সমীচীন নয়- ইবাদতকে বিনোদন ও খেল-তামাশার বস্তুতে পরিণত করা। সত্য কথা হলো, সেলফি তোলা, ভিডিও করা, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা ইত্যাদি- এর মাধ্যমে ইবাদতের মূল আবেদনটাই ক্ষুণ্ণ হয়ে যায়। এটা বোঝার জন্য খুব বেশি বোধ-বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না।

আলেমরা বলেন, কোরবানির পশু জবাইয়ের ছবি নয়, হৃদয়ে জাগ্রত হোক পিতা-পুত্রের ত্যাগ ও সমর্পণের ছবি! কারণ, কোরবানি-হজ এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল ইবাদত। যদিও আজ আত্মপ্রচার প্রবণতার উন্মাদনা থেকে হজ ও কোরবানির মতো ইবাদতগুলো রক্ষা পাচ্ছে না!

আমরা যদি একটি বারের জন্যও ভেবে দেখি, এতে আমার হজ-কোরবানির মতো গুরুত্বপূর্ণ আমল ইখলাস ও তাকওয়াশূন্য হয়ে পড়ছে না তো? একথা তো সবারই জানা, কোরবানির এ সুন্দর সুঠাম পশুর রক্ত-গোশত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছবে না; পৌছবে কেবল আমাদের নেক নিয়ত ও অন্তরের তাকওয়া। হাদিসেও এ মর্ম বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের চেহারা-আকৃতি ও সম্পদের দিকে তাকান না। তিনি তাকান তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে। -সহিহ মুসলিম : ২৫৬৪

লোকের ‘বাহবা’ কুড়ানোর মানসিকতা ইখলাস ও তাকওয়া পরিপন্থী কাজ। আমাদের সবকিছু তো আল্লাহর জন্য; মানুষের বাহবা দিয়ে আমাদের কী লাভ! শুনুন কোরআন মাজিদের ঐশী বাণীতে মুমিনের ভাষ্য, ‘নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ আল্লাহরই জন্য। যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক।’ -সুরা আনআম : ১৬২

কোরবানির পশু জবাইয়ের সময় দোয়া হিসেবে ওপরের বাক্যগুলো আমরা উচ্চারণ করি। অথচ এর শিক্ষা ও মর্ম থেকে আমরা অনেকেই গাফেল থাকি। শেষ কথা, মুসলিমের কোনো আমলই আচারসর্বস্ব নয়। কোরবানিও তেমন নিছক আচার-অনুষ্ঠান নির্ভর কোনো আমল নয়। এতে রয়েছে তাওহিদ ও আল্লাহর বড়ত্ব-মহত্বের প্রকাশ।

তার স্মরণ ও আনুগত্যের শিক্ষা, সর্বোচ্চ সমর্পণের দীক্ষা। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কীভাবে আল্লাহর হুকুমের সামনে নিঃশর্ত আনুগত্যের নজরানা পেশ করেছেন! কীভাবে ছোট্ট শিশু ইসমাইল মহান প্রভুর নির্দেশের সামনে মাথা পেতে দিয়েছেন! কীভাবে মহান শিশু-নবীর পরিবর্তে জান্নাতি পশু কোরবানি হলো! এসব কার কারিশমা? আমরা যদি কোরবানির সময় নবীদ্বয়ের স্মৃতিচারণ করি। পিতা-পুত্রের সেই ত্যাগ ও সমর্পণের শিক্ষা অন্তরে জাগ্রত করি, ছবি-সেলফি নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে যদি আমরা মহান আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করি এবং মনে মনে দোয়ায় মগ্ন থাকি তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহতায়ালা আমাদের কোরবানি কবুল করবেন। সুতরাং পশু জবাইয়ের ছবি নয়, হৃদয়ে জাগ্রত হোক পিতা-পুত্রের ত্যাগ ও সমর্পণের ছবি!

 

 

কিউএনবি/আয়শা/১৫ জুন ২০২৪,/রাত ৮:২৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

June 2025
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit