আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর গত প্রায় আট দশকে ইরানের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক নানান চড়াই-উৎরাইয়ের ভেতর দিয়ে গেছে; কখনো বন্ধুত্ব, আবার কখনো চরম শত্রুতা। তবে গত কয়েক বছর ধরে দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা আলাদা মাত্রা পেয়েছে। যার সবশেষ রূপ দেখা গেল গত শনিবার রাতে।ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইসরাইলের ভূখণ্ডে সরাসরি হামলা চালাল ইরান।এই হামলায় কয়েকশ কামিকাজি ড্রোন এবং মিসাইল ব্যবহার করেছে তারা। বিভিন্ন সূত্র থেকে যা জানা যাচ্ছে, তাতে ইরানের ভূখণ্ড এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে সক্রিয় প্রক্সি গ্রুপগুলো মিলে প্রায় সাড়ে তিনশ ড্রোন এবং মিসাইল ছোড়া হয়েছে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে।
গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরাইল। এতে বিপ্লবী গার্ডের দুই কমান্ডারসহ ৭ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হন। এই ঘটনার পর থেকেই প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলো ইরান। দুই সপ্তাহ পর তারা সেই প্রতিশোধ নিলো। কিন্তু যেভাবে হামলা চালানো হলো এবং হামলার আগে-পরে ইরানের কূটনৈতিক কলাকৌশল থেকে প্রতীয়মান হয়, এই হামলা যতটা না শত্রুপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য, তার চেয়ে বেশি মুখ রক্ষার জন্য!
হামলার পরপরই বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ব্রিফিং করেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান। তিনি তাদের বুঝান, ইসরাইলের বিরুদ্ধে যে হামলাটি তারা করেছে সেটি তাদের ন্যায্য অধিকার। তিনি বলেন,হামলার ৭২ ঘণ্টা আগেই প্রতিবেশী দেশগুলোকে জানানো হয়েছিল। আমেরিকাকেও তারা জানিয়েছিলো যে, এই হামলা হবে সীমিত এবং নিয়ন্ত্রিত। হামলার পর তারা আর উত্তেজনা বাড়াতে চান না।
তুরস্ক, জর্ডান এবং ইরাকের কর্মকর্তাদের বরাতে রয়টার্স বলেছে, ইসরাইলে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েক দিন আগেই দেশগুলোকে বিস্তৃত নোটিশ দিয়েছিল ইরান। ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবির বিষয়ে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, হামলার আগে তারা ওয়াশিংটন ও তেহরান উভয়ের সঙ্গে কথা বলেছিল।
তুরস্ক একদিকে ইরানের প্রতিবেশী অন্যদিকে ন্যাটোর সদস্য। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বার্তা আদান-প্রদানে তুরস্ককেই বেছে নিয়েছিল ইরান। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ধারণা করছেন, তুরস্কের মাধ্যমেই আমেরিকার মনোভাব সম্পর্কে ধারনা নিয়েছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সিগন্যাল পেয়েই তারা হামলা চালিয়েছে।
সবমিলিয়ে এটা স্পষ্ট যে, ইরানের হামলা অতর্কিত ছিল না। তারা তথ্য দিয়েই হামলা চালিয়েছে এবং বড় ধরনের কোনো ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যও তাদের ছিলো না। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যই দেশটির অফিসিয়াল অবস্থান। এর বাইরে ইরানের সামরিক এবং বেসামরিক নেতারা যেসব উত্তেজক বক্তব্য দিচ্ছেন সেগুলো মূলত ইরানের জনগণ এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানপন্থী প্রক্সিদের উদ্দেশে।
ইরান এবং ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীদের মধ্যে আছে: সৌদি আরব, কাতার, আরব আমিরাত, জর্ডান, সিরিয়া, মিশর, কুয়েত ইত্যাদি। এরমধ্যে সিরিয়া ছাড়া সবগুলো রাষ্ট্রই আমেরিকার বন্ধু। এরা এমনকি গাজায় গণহত্যার ইস্যুতে পর্যন্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে তেমন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এই দেশগুলোতে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন আছে। অফিসিয়াল অবস্থান যাই হোক, মুসলিম এই দেশগুলো ইসরাইল-আমেরিকার সঙ্গে লিয়াঁজো বজায় রাখার কৌশলী কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। অতএব এই দেশগুলোকে আগে থেকে হামলার তথ্য দিলে তারা যে বিষয়টি নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে শলাপরামর্শ করবে তা সহজেই অনুমেয়। আর হামলার সময় ইসরাইল এবং আমেরিকার কৌশলই বলে দিচ্ছে- তারা ইরানের প্রতিবেশী সুন্নি দেশগুলোকে নিয়েই পরিকল্পনা সাজিয়েছিল।
ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের সীমান্ত নেই। ইরান থেকে ইসরাইলে যেতে হলে অন্তত দুইটি দেশ পার হতে হয়। ইরাকের সীমান্তবর্তী ইরানের মেহের বর্ডার থেকে ইসরাইলের জর্ডান সীমান্তবর্তী বেইত জেরা এলাকার দূরত্ব প্রায় সাড়ে ১১শ কিলোমিটার। গুগল ম্যাপ বলছে, প্রাইভেট কারে এই দূরত্ব পাড়ি দিতে লাগবে প্রায় ১৩ থেকে ১৪ ঘণ্টা। আর ইরানের বহুল চর্চিত ‘সাহেদ ১৩৬’ ড্রোনের এই পথ পাড়ি দিতে লাগবে প্রায় পৌনে ৬ ঘণ্টা! কারণ এই ড্রোনের গতি ঘণ্টায় প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার।
কিউএনবি/আয়শা/১৫ এপ্রিল ২০২৪,/রাত ১০:১৪