ডেস্কনিউজঃ চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের বিকল্প নেই। একমাত্র সংলাপের মাধ্যমেই সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব। যুদ্ধের মধ্যেও সংলাপ হয়। এজন্য প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে ছাড় দিতে হবে। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ভোটার সচেতনতা ও নাগরিক সক্রিয়তা কার্যক্রম রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার লক্ষ্যে জাতীয় সংলাপ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের আয়োজনে এবং সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সহযোগিতায় এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাগত বক্তব্যে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংলাপের বিকল্প হলো সংলাপ। নাগরিকদের মতো আমরাও মনে করি আলোচনার টেবিলে বসেই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। আমরা কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি না। তবে আমাদের প্রস্তাবগুলো সম্ভাব্য আলোচনার এজেন্ডা হতে পারে।
সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, নব্বইয়ে প্রণীত তিনজোটের রূপরেখায় বলা হয়েছিল আমরা ভবিষ্যতের সমস্যা সমাধানে আলাপ-আলোচনা করেই সমাধান করবো। কিন্তু আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদরা সেই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেছেন।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা এবং ধর্ম থেকে আমরা দেখতে পাই সংলাপের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হয়েছে। তাই সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই বলে আমরা মনে করি।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. রওনক জাহান বলেন, বড় দুটো দলের মধ্যে যে সংলাপ হতে হবে সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সংলাপের ব্যাপারে ঐকমত্য নেই। কিন্তু শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি, নিজ সংসদীয় এলাকার উন্নয়নের জন্য আর্থিক বরাদ্দ পাওয়া এবং নিজেদের সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে ঐকমত্য আছে বড় দুই দলের মধ্যে। সংসদ সদস্যদের আচরণবিধি প্রণয়নের ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য নেই। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার ব্যাপারে অনঢ় অবস্থান লক্ষ্য করা হয়। আমি মনে করি বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটে নিরসনের জন্য রাজনৈতিক ও আইনি সংস্কার দরকার। কিন্তু শুধু আইনি সংস্কার করেই সমস্যার সমাধান হবে না। একইসঙ্গে দরকার রাজনৈতিক সংস্কারের ইতিবাচক উন্নয়ন। নির্বাচনে পরাজিত দলের নেতাকর্মীদের জীবন-জীবিকা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য থাকা দরকার।
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ব্রিটিশ আমলে সীমিত পরিসরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। সেখানে ব্যালট ছিনতাই বা কেন্দ্র দখলের কোনো সংবাদ আমরা শুনিনি। পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে সামরিক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়েছিল। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে বলা হয়েছে, জনগণই হবে রাষ্ট্রের মালিক, অর্থাৎ বাংলাদেশ হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর গণতন্ত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা থাকলেও কমিশন তা প্রয়োগ করছে না। গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনের পর কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছিল তা মানা হয়নি। কমিশন চাইলে দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতো। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সদিচ্ছা থাকা দরকার। আমি মনে করি, বৃহত্তর সমঝোতার লক্ষ্যে সংলাপের বিকল্প নেই।
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই জাতি হিসেবে আমরা সংকটের মধ্য দিয়ে পার করছি। ১৯৭৪ সালে তৈরি হওয়া সাংবিধানিক সংকট ১৯৯১ সালে সমাধান হয়েছে। আবার ২০০৬ সালে এসে আমরা নতুন সংকটে পড়ে গেলাম। ২০১৪ সালে আবার সংকট তৈরি হয়, যার শুরু হয়েছে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে। সংবিধান থাকলেও সাংবিধানিকতা নেই, প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই। আমাদের সংশোধনীগুলো জনগণের কল্যাণে নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা আশাবাদী হতে চাই। আমরা মনে করি পরিবর্তন দরকার, পরিবর্তন হতেই হবে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক বলেন, বিভিন্ন পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি তোলা হলেও কোন প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে তা কেউ বলতে পারছে না। এর দায় শুধু সরকারি দল ও ক্ষমতাসীন জোটের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। অতীতে নানাভাবে রাজনীতিবিদদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, ২০১৩-১৪ সালে জ্বালাও-পোড়াও চালানো হয়েছে। আমি মনে করি, নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে একটি ঐকমত্য তৈরি হওয়া দরকার। কিন্তু নৈরাজ্য সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি করতে হলে দায় নিতে হবে। আমি মনে করি, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রবেশ নিয়ে কথা না বলে নৈতিকতা নিয়ে রাজনীতি করা দরকারের বিষয়ে কথা বলা দরকার। আমি মনে করি, দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা হওয়া দরকার। তা হলে তা হবে একটি মাইলফলক। নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। সংলাপ হলে পারস্পারিক আস্থা রাখতে হবে, ছাড় দেয়ার মানসিকতা বজায় রাখতে হবে।
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হারুর অর রশিদ বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষ্যে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। যারা সংলাপে বসতে রাজি নন, তারা মূলত সংকট এড়িয়ে যেতে চান। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। এজন্য কতগুলো রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার দরকার। তিনি বলেন, এখনকার সংকট তৈরি হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের মধ্য দিয়ে। এই পদ্ধতির সংস্কার না করে সরকার একতরফাভাবে তা বাতিল করা হয়েছে। অথচ সংসদীয় কমিটির সভায় মহাজোটের সকল নেতা এই পদ্ধতি বহাল রাখার কথা বলে গেছেন। সরকার তার নিজের স্বার্থে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা করছে। এই প্রবণতাও বন্ধ হওয়া দরকার।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পূর্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমার ওপর আস্থা রাখুন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। আমি মনে করি, এখন আর সংলাপের পরিবেশ নেই। তাছাড়া সংলাপের লক্ষণও নেই। দেশের রিজার্ভ কমে ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলছেন, রিজার্ভ কোনো সমস্যা নয়। তাই সংলাপ করে লাভ কী? মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে। সরকারি দল আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবেশ নষ্ট করছে। বিগত ১৫ বছর ধরে এ অবস্থা চলছে। তারপরও সংলাপ যদি হতে হয়, তাহলে সুনির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডা নির্ধারণ করতে হবে, যাতে আমরা ভবিষ্যতে সংকট এড়াতে পারি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ স¤পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বাংলাদেশ আজ দ্বি-দলীয় বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, দেশে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে, নির্বাচনী ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গেছে। তাই গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য এ ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার নেই। নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে, আনুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতি চালু করতে হবে। এরজন্য জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের ধারার আলোকেই রাজনীতি করতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ চাইলেও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে না। কারণ এখানে আরও অনেক স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ রয়েছে। আমাদের রিজার্ভ কমছে, রেমিটেন্স করছে, খেলাপিঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ২০০৯ সালে খেলাপিঋণ ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকা, এখন তা ৪ লাখ কোটি টাকা। এখানে দলীয় লোকেরাই সুবিধা পাচ্ছে। এখানে ফায়দাতন্ত্রের রাজনীতি তৈরি হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী নিজে চাইলেও এই ধারা ভাঙতে পারবেন না। তিনি বলেন, সব দলই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চায়। তাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা কীভাবে হতে পারে তা ঠিক করা দরকার এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হওয়া দরকার, যার একটি আইনি ভিত্তি থাকবে। একটি নূন্যতম নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সরকারি কর্মকমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আমরা এখন সেল্ফ সেন্সরশিপের মধ্যে বসবাস করছি। আমাদের মনে সবসময় একথা বিরাজ করে, কথা বললে বিপদ হবে না তো। আমরা মনে করি, সংলাপেই সমাধান হওয়া দরকার। কিন্তু সংলাপের পূর্ব শর্ত হলো নিজ আদায় করা, আর কিছু ছাড় দেয়া। না হয় সংলাপ অতীতের মতো ব্যর্থ হবে। তিনি বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, নির্দলীয় সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সহায়ক নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। বর্তমানে রাজনীতি, শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে টাকার খেলা চলছে। এটাও বন্ধ হওয়া দরকার। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে পরিশুদ্ধ করার জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতি চালু করা দরকার।
অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ৫টি ভিন্ন নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং সংঘাতের আশঙ্কা শোনা যাচ্ছে। আমরা মনে করি, সংঘাতের এড়াতে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। শত্রুর সঙ্গেও সংলাপ হতে পারে। আমি মনে করি আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে। তাই যে কোনো উপায়ে একটি নির্বাচন করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে হবে এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তুলতে হবে।
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর নিজের দলকে নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য দাবি করে নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্যে বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদের দলকে নিবন্ধন দেয়নি। সরকারি একটি এজেন্সি আমাদেরকে বলেছিল ভোটে গেলে আমাদেরকে নিবন্ধন দেয়া হবে। আমরা সরকারের অধীনে ভোটে যেতে না চাওয়ার কারণে নিবন্ধন দেয়া হয়নি। এই নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন। সংকট নিরসণে সংলাপ প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুদ্ধের মধ্যেও আলোচনা হয়।
কিউএনবি/বিপুল/০৯.১০.২০২৩/ সন্ধ্যা ৬.২৬