শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০২:১৭ অপরাহ্ন

রুমকী’র কথা, রুমকী’র চিঠি -৬ : দুই নম্বরী

Reporter Name
  • Update Time : শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০২৩
  • ৮০৬ Time View

দুই নম্বরী
———–
নাহিদের এক খালার বাড়ী প্রত্যন্ত গ্রামে। একদম অজ পাড়া গাঁ। খালাবাড়ীর পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা নদী। ছোটবেলায় এই নদীর এপার ওপার সাঁতার কাটত নাহিদ। এই খালা বাড়ীতে নাহিদ এসেছে। তার সংগে রুমকী। খালাবাড়ীতে ধুম পড়েছে খাওয়া দাওয়ার। নাহিদের খালা প্রিয় রান্না গুলো রেঁধে দেয়, পিঠা করে, বিন্নি ধানের খৈ ভাজে। নাহিদ রুমকী খালার আপ্যায়নে মুগ্ধ। আদর স্নেহের বন্যা বয়ে দেয় খালা। এখন গ্রামেও বিদ্যুৎ এসেছে। কালার টিভি, মাথার উপর শন শন করে পাখা ঘুরে। বেশি রাত জাগেনা নাহিদ রুমকী। রাত দশটার পর ঘুমিয়ে পরে ওরা দুজনে।

খুব ভোরে অনেক শোরগোল শোনা যাচ্ছে। চিৎকার, হৈ হাঙ্গামায় ঘুম ভেঙ্গে যায় নাহিদ রুমকীর। ঘর থেকে বের হয়ে দুজনে দেখে সমগ্র বাড়ীটি ঘিরে ফেলেছে শত শত লোক। তাদের হাতে লাঠি সোটা, বল্লম। অনেকের হাতে মানুষ সমান রাম দা। এই লোকজনের মধ্যে থেকে এগিয়ে আসল রুমকীর ডাক্তার ভাই। দ্রুত এসে রুমকীর হাত ধরে হিড়হিড় করে রুমকীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নাহিদ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে। কি এক অজানা কারণে সে চলত শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া সশস্ত্র এত লোকজনের বিরুদ্ধে সে একাই বা লড়বে কিভাবে ? নাহিদের খালা চিৎকার করছে। নাহিদ, বৌমাকে যেতে দিসনা। ওকে আটকা। কিন্তু নাহিদ অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে রুমকীকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ওর বড় ভাই।

একটা প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল নাহিদের। সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। বিছানা থেকে সে দেখতে পেল নাহিদের মেয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে পারফিউমের বোতল ফেলে দিয়েছে। বোতল পড়ার শব্দে নাহিদের ঘুম ভেঙে গেছে। রুমকীকে নিয়ে সে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিল। নাহিদের স্ত্রী, নাহিদের মেয়ে তাড়াহুড়ো করছে। ওরা কলেজে যাবে। কলেজে আজ মেয়ের বিদায়ী অনুষ্ঠান। কয়েকদিন বাদেই এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা।

নাহিদের মনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠল রুমকীর জন্যে। চোখে হাত দিয়ে দেখল চোখ তার ভিজে গেছে। স্বপ্নে রুমকীকে ওর বড়ভাই নিয়ে যাওয়ার জন্যে নাহিদ কাঁদছিল। স্বপ্নের কান্না বাস্তবে অঝর ধারায় অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বালিশের কাছ থেকে সেলফোনটা টেনে নিয়ে নাহিদ কল দিল রুমকীকে। নিউইয়র্কে এখন রাত দশটা। রুমকী সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করল। ফোন ধরেই রুমকী বিস্ময় প্রকাশ করল। এই সময়েতো নাহিদ কখনো কথা বলেনা।

নাহিদ কিছুক্ষন আগে দেখা স্বপ্নের কথা বলল রুমকীকে। নাহিদ বলল, আমি তোমাকে পালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম খালাবাড়ীতে। তোমার ডাক্তার ভাই গুন্ডা পান্ডা নিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তোমাকে। খুব কষ্টের স্বপ্ন রুমকী। হেসে হেসে রুমকী বলল, বাস্তবে তুমি আমাকে পালিয়ে নিয়ে যেতে পারনি অথবা আমি তোমার সঙ্গে পালাতে পারিনি। কিন্তু এবারে বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ পালাবে। দেশ ছেড়ে ভাগবে তারা। খুব সহসাই এই পালানো শুরু হবে নাহিদ। তুমি দেখ, খুব দ্রুত এমন কিছু ঘটবে।

নাহিদ বুঝতে পারে রুমকী চলে যাচ্ছে রাজনৈতিক আলাপ চারিতায়। নাহিদ বলল, সেটা কি রকম ? খুলে বলো। রুমকী নিউইয়র্কের কুইন্স থেকে শুরু করল তার কথা। একটা লম্বা সময় ধরে কিছু লোকজন অনেক টাকা কামিয়েছে। এগুলো দুর্নীতি করে তারা অর্জন করেছে। এগুলো অবৈধ টাকা। এই টাকাগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ তারা বিদেশে পাচার করেছে। এখন এই টাকা গুলোর নিরাপত্তা আর সদ্যবহারের জন্যে দ্রুত তাদের পালাতে হবে। বাতাসে ওরা বিপদের গন্ধ পাচ্ছে। ওরা পালাবেই।

নাহিদ জিজ্ঞাসা করল, ওরা কারা ? তুমি কাদেরকে মিন করছ। রুমকী বলল, ওরা কিছু আমলা, ওরা কিছু রাজনীতিবিদ আর দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ী। ওরা ওদের পরিণতি খুব একটা ভাল মনে করছেনা। নাহিদ জানতে চাইল, এগুলো কি তোমার মনগড়া কথা না নিরেট কোন তথ্য আছে ? রুমকী জানাল, শুধু আমেরিকাতেই অসংখ্য ‘ল’ ও ইমিগ্রান্ট ফার্ম গুলোতে অস্বাভাবিক হারে এরা যোগাযোগ করছে। পুরো পরিবার সহ দেশ ছাড়ার চেষ্টা তারা করছে।

এরপরে রুমকী প্রসঙ্গ পাল্টাল। দেশে নির্বাচনের হাওয়া লেগে গেছে। সরকার চায় সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন করতে। বিএনপি সহ অন্যান্য বিরোধীদলগুলো চায় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে। এ নিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো যা বলছে তা পক্ষান্তরে চলে যাচ্ছে বিরোধী দলগুলোর পক্ষেই। এরমধ্যে প্রধান বিরোধীদল একদফার ডাক দিয়েছে। সরকার পতনের ডাক। আছে নাহিদ, আন্দোলনে কি সরকারের পতন হবে ?

নাহিদ হেসে জবাব দিল, সেরকম কিছু বুঝতে পারছিনা। তবে বিএনপির মধ্যে একটা সাজ সাজ রব দেখতে পাচ্ছি। কয়েকদিন যাবৎ তারেক রহমান লাগাতার মিটিং করছেন। বিএনপির নির্বাহী কমিটিকে পার্ট পার্ট করে মিটিং করছেন। কোনদিন উপদেষ্টা, ভাইস চেয়ারম্যানদের নিয়ে, কোনদিন সম্পাদক মন্ডলীর সদস্যদের নিয়ে আবার কোন কোন দিন বিভাগওয়ারী নির্বাহী কমিটির সদস্যদের নিয়ে। রুমকী বলল, এ নিউজগুলো আমিও পাচ্ছি। অঙ্গদল গুলোর নেতাদের সাথেও তিনি মিটিং করেছেন। নাহিদ বলল, বিএনপির কর্মকান্ড দেখে মনে হচ্ছে, ওরা এক দফার আন্দোলন সফল করেই ছাড়বে।রুমকী বলল, এছাড়া বিএনপির আর করণীয় কিছু নেই।

একটা সফল আন্দোলন এত সহজ নয়। নাহিদ রুমকীকে বলল। বিএনপির হাজারও সমস্যা আছে। সাংগঠনিক ভাবে তারা অগোছালো আছে। অনেক জেলায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর গ্ৰুপিং এ দলীয় কার্যক্রম স্থবির হয়ে পরে আছে। অনেক নেতা পদ বাণিজ্য করে অযোগ্য নেতৃত্ব বানিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে আন্দোলন করে কতটুকু সুফল পাবে নিএনপি, আমি বুঝতে পারছিনা।

রুমকী বলল, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে কিন্তু বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত ছিলনা। এক খালেদা জিয়ার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব আর তাঁর ব্যক্তিগত ইমেজকে পুঁজি করে তিনি বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে তারেক রহমানের একটা চমৎকার ভূমিকার কথা স্বীকার করতে হয়, তিনি সুদূর লন্ডন থেকে এত দুর্যোগ আর বৈরী পরিস্থিতির মাঝেও দলকে টিকে রাখতে পেরেছেন। বিএনপির একটা নেতাকর্মীও দলছুট হয়নি। কোন বিদ্রোহ নেই বিএনপিতে।

রুমকী বলল, আজ অনেক কথা হল। রাত হয়েছে, ঘুমাতে যাব। তোমাকে চিঠি লিখতেছি। চিঠি অর্ধেক লেখা শেষ হয়েছে। বাকিটুকু শেষ হলে পাঠিয়ে দেব। আজ কোন গল্প বলবেনা ? নাহিদ বলল, ঠিক আছে পাঠিয়ে দিও। গল্পের ব্যাপারে নাহিদ বলল, তুমি শুরুতে যে দেশ ছেড়ে পলায়ন পর টাকা পাচারকারীদের সম্পর্কে যা বললে, তার প্রেক্ষিতে আমি একটি গল্প বলতে পারি। এরা কত ধুরন্ধর আর চালবাজ। গল্পটি শোন। রুমকী বলল, শুরু কর।

মাঝ সমুদ্রে তিনজন মানুষ ঝড়ের কবলে পড়েছে। তাদের নৌকা প্রায় ডুবো ডুবো অবস্থা। নৌকায় তিনজন তিন দেশের মানুষ। একজন আমেরিকার, একজন ভারতের আর একজন বাংলাদেশের মানুষ। এই তিনজনই তখন নিজেদের প্রাণ রক্ষার জন্যে জল দেবতার কাছে আকুলভাবে সাহায্য কামনা করল। জল দেবতা তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে বলল, ঠিক আছে আমি তোমাদেরকে বাঁচাতে পারি তবে তোমাদের একটা পরীক্ষা দিতে হবে। তোমরা এমন কিছু সমুদ্রে ফেলে দিবে যাতে আমি খুঁজে না পাই। তিনজনই রাজি হল।

প্রথমে মাথা গরম আমেরিকান সমুদ্রের পানিতে ঠাস ঠাস গুলি করে জল দেবতাকে বলল, এখন খুঁজে আনো দেখি বুলেট গুলো ? জলদেবতা নিমিষেই ছয়টি বুলেট এনে আমেরিকানকে দিয়ে বলল, তুমি ফেইলড। ভারতীয়টির চিকন বুদ্ধি, সে সমুদ্রের পানিতে একটা সুঁচ ফেলে দিয়ে বলল, এবার আনো দেখি সুঁচটি। জল দেবতা সুঁচটিও নিমিষে খুঁজে এনে ভারতীয়কে ফেরত দিয়ে বলল, তুমিও ফেইলড। এবারে বাংলাদেশীর পালা। বাংলাদেশীটি জল দেবতা এবং সঙ্গী দুজনকে মুখ অন্যদিকে ফেরাতে অনুরোধ করল। এরপর প্যান্টের চেইন খুলে সমুদ্রের পানিতে প্রস্রাব করে জল দেবতাকে বলল, পানিতে আমি মুতে দিয়েছি, পারলে খুঁজে আনো ?

রুমকী হা হা হা করে হেসে বলল, তাহলে টাকা পাচারকারীরা এরকম কোন দুই নম্বরী বুদ্ধি বের করবে ? এরা কি দেশ ও দুনিয়াবাসীকে চ্যালেঞ্জ করে বলবে, পারলে পাচারকৃত অর্থ খুঁজে বের করো ? নাহিদ বলল, ওরাতো দুই নম্বরই। ওরা সমুদ্রে ফোটা জল নির্গত করে বলতে পারে , খুঁজে আনো সেই জলকণা।

 

লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।

 

কিউএনবি/নাহিদা /১২.০৮.২০২৩/রাত ৯.৩০

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit