এম, এ, রহিম, চৌগাছা (যশোর) : যশোরের চৌগাছায় ২০২৩ সালের সাত মাসে ২০ জন আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়াও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন আরোও অর্ধশত জন। এদের মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থী, শিশু, ব্যবসায়ী, স্কুল শিক্ষক, বৃদ্ধানারী ও যুবক-যুবতী। আত্মহত্যাকারীরা বিষপান, ঘাসপোড়া পান ও গলায় ফাঁসসহ বিভিন্ন পন্থায় আত্মহত্যা করে থাকেন। এ আত্মহত্যার ঘটনায় রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে এ উপজেলার সচেতন মহলকে। এদিকে পরীক্ষায় ফেল করে, প্রেমে ব্যার্থ হয়ে, পারিবারিক কলোহসহ নানা কারণে বিষপান, গলায় রশি, ঘাসপোড়াপানসহ বিভিন্নভাবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন অর্ধশত জন।
চৌগাছা হাসপাতাল ও থানা সুত্রে জানা যায়, ২৭ মে শনিবার দিনের বেলা চৌগাছা থানার সামনে মিজানুর রহমান (৬০) নামের এক ব্যবসায়ী নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ঝুলন্ত অবস্থায় প্রতিবেশিরা তাকে উদ্ধার করেন। মিজানুর রহমানের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার চানপাড়া গ্রামে। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ চৌগাছা পৌর শহরের থানা পাড়ায় নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন। ২৬ মে আলেয়া খাতুন (১৯) নামে চার মাসের এক গর্ভবতী নারী আগাছানাশক (ঘাসপুড়া) পানকরে আত্মহত্যা করেন। আলেয়া চৌগাছা পৌর শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের হুদোপাড়ার শিপন আলীর স্ত্রী। ৩১ মে উপজেলার মাশিলা গ্রামের শফিউল্লাহর ছেলে আব্দুল হোসেন (৩৮) গলাই ফাঁস দিয়ে, আত্মহত্যা করেন।
২৩ এপ্রিল রাতে মজিদুল হক ওরফে মইদুল (৭৮) নামে এক স্কুল শিক্ষক গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি উপজেলার বল্লভপুর মাধবপুর পাড়ার মৃত মোজাম্মেল হকের ছেলে ও দক্ষিন বল্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (অবসরপ্রাপ্ত) শিক্ষক। ২০ এপ্রিল রাতে আসমা খাতুন (৯) নামে এক বাকপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী মায়ের উপর অভিমান করে ওড়না দিয়ে শয়ন কক্ষের বাঁশের আড়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। সে উপজেলার হাকিমপুর ইউনিয়নের স্বরুপপুর গ্রামের নুরনবীর মেয়ে এবং স্বরুপপুর প্রতিবন্ধী স্কুলের ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থী। ২৩ এপ্রিল রাতে স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য করে রায়হান হোসেন (২৮) নামে এক যুবক গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি উপজেলার সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের মাকাপুর গ্রামের মৃত নাসির উদ্দিনের ছেলে।
৫ মার্চ চ¤পা রাণি (৪৫) নামে এক গৃহবধূ নিজ ঘরের আড়াই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি উপজেলার জগদীশপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের সুবল চন্দ্র বিশ্বাসের স্ত্রী। ১৬ মার্চ রাতে দিনোবন্ধু (৫৫) নামে এক বৃদ্ধ নিজের ঘরে সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি উপজেলার পাতিবিলা গ্রামের বাসিন্দা। বর্তমানে পৌর শহরের নিরিবিলি পাড়ায় বসবাস করতেন। ১৮ মার্চ বিকালে সাবিনা ইয়াসমিন ডলি (৩০) নামে এক গৃহবধূ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি উপজেলার স্বরুপদাহ ইউনিয়নের মাশিলা গ্রামের বাসিন্দা বকুল হোসেনের স্ত্রী। বর্তমানে তারা পৌর শহরের পান্টিপাড়ায় বসবাস করতেন। ২৪ মার্চ সিবানী রাণী মন্ডল (৭০) নামে এক নারী বিষপানে আত্মহত্যা করেন। তিনি উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের রাণীয়ালী গ্রামের গৌয়ুর মন্ডলের স্ত্রী।
এ ছাড়াও মাহফুজুল হক (৭৫) নামে এক ব্যবসায়ী গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি নিজ বাড়ীর ছাদের উপর হেলে থাকা মেহগনী গাছের ডালের সাথে রশিদিয়ে আত্মহত্যা করেন। পরিবারের দাবী শরীরের যন্ত্রনা সইতে না পেরে চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করেন। তিনি উপজেলার স্বরুপদহ ইউনিয়নের টেঙ্গুরপুর গ্রামের বাসিন্দা। খাদিজা খাতুন (১৯) নামের এক গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেন চৌগাছা থানা পুলিশ। তিনি উপজেলার সিংহঝুলী ইউনিয়নের পিতম্বরপুর ইসলাম পাড়ার নাহিদুল ইসলামের স্ত্রী। ঘাসপুড়া খেয়ে অনিক কুমার সরকার (১২) নামে এক স্কুল ছাত্র আত্মহত্যা করে। সে উপজেলার উত্তর কয়ারপাড়া গ্রামের ভরত কুমার সরকারের একমাত্র ছেলে। নিহত অনিক সিংহঝুলী শহীদ মশিউর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলো। হাজেরা বেগম (৬০) নামে এক গৃহবধূ বিষপানে আত্মহত্যা করেন। তিনি উপজেলার সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের সুখপুকুরিয়া গ্রামের শের আলীর স্ত্রী।
১৯ জুলাই উপজেলার জগদিশপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেনের মেয়ে স্কুল ছাত্রী (১৪) বিষপান করে, ২০ জুন পৌর শহরের বিশ্বাস পাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে রুমন হোসেন (৩২) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। ১১ জানুয়ারী সন্ধ্যায় স্বামীর উপর অভিমান করে লাকিয়া বেগম (২৫) নামের এক গৃহবধূ বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন। লাকিয়া উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের পেটভরা গ্রামের ছামছুল হোসেনের স্ত্রী। ১৬ জানুয়ারী রাতে উপজেলার মাড়–য়া গ্রামের মারজন মন্ডল (৬৫) নামে এক বৃদ্ধ রান্না ঘরের আড়াই গলায়ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ২০ জানুয়ারী বিকেলে চাকরি না পেয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে হাবিবুর রহমান (২৯) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ থেকে লেখাপড়া শেষ করেন। তিনি উপজেলার স্বরুপদাহ ইউনিয়নের জলকার-মাধবপুর গ্রামের মৃত আয়নাল হকের ছেলে।
এদিকে চৌগাছা থানার ওসি সাইফুল ইসলাম সবুজ এ উপজেলায় আত্মহত্যা প্রবনতা কমাতে মাঠে ময়দানে কাজ করে চলেছেন। তিনি জনসচেতনতা বাড়াতেই গ্রামে গ্রামে বিট পুলিশিং সভা করে, প্রতি সপ্তাহে গ্রামপুলিশ সদস্যদের হাজিরা সমাবেশে, এসএসসি, এইচ এসসি ও সমমানের পরীক্ষার হলের বাইরে অপেক্ষায় থাকা অবিভাবকদের, শুক্রবার জুম্মার নামাজের আগে বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লীদের ও ক্রিকেট-ফুটবল খেলার মাঠে হাজির হয়ে আত্মহত্যা ও মাদক সেবন না করার জন্য উৎসাহিত করে থাকেন।
এ ব্যাপারে চৌগাছা সরকারি মডেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আল-ইমরান বলেন, চৌগাছা উপজেলায় আত্মহত্যার প্রবনতা বেশী। আত্মহত্যা করার জন্য বিষপান-গলায় রশি দেওয়া রোগী আমাদের এখানে প্রতিদিন গড়ে ২/৪ জন আসেন। অনেকে চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে বাড়ীতে ফেরেন। আবার কেউ মারাও যান। মানুষের মনমোগজে সহ্যক্ষমতা কমেগেছে। তা ছাড়া কৃষি প্রধান এলাকা হওওয়ায় বিষ, ঘাসপুড়া ইত্যাদি অতি সহজে হাতের কাছে পাওয়া যায়। চৌগাছা থানার ওসি সাইফুল ইসলাম সবুজ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, এ সকল ঘটনায় চৌগাছা থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।
কিউএনবি/আয়শা/৩১ জুলাই ২০২৩,/বিকাল ৪:৪৮