রুমকী’র চিঠি -২ : বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা
————————————————————————–
শেষ বিকেলে মতিঝিল অফিসে নিজের ভিতরে নিজেই ছটফট করছে নাহিদ। হৃদয়ের মাঝে এক অজ্ঞাত খচখচানি যেন। কোথায় যেন একটা বীনার তার ছিড়ে গেছে। তারের টানে ছন্দপতন ঘটিয়ে বেসুরো এক টুংটাং শব্দে বিভ্রান্ত হচ্ছে নাহিদ। কি হলো আজ তার ? মতিভ্রম দূর করতে একা একা হাসছে নাহিদ। মনে মনে বলছে বীনার তারটা এখানে নয়, ছিড়ে গেছে নিউইয়র্কের কুইন্সে, কিউ গার্ডেনে। রুমকী আজ তাকে চিঠি লিখেনি। বার কয়েক নজর বুলিয়েছে হোয়াটস্যাপ এ। নাহ ! কোন সাড়া নেই রুমকীর।
নাহিদ ল্যান্ড ফোনে কল দিয়েছে বাসায়। শেলীর কাছে জানতে চাচ্ছে, বাসায় ফেরার সময় কিছু নিয়ে আসতে হবে কিনা ? শেলী নাহিদকে অবাক করে দিয়ে একটা কথা বলল, তোমার মনটা কি খারাপ ? তোমার কণ্ঠ কেন জানি ভারী মনে হচ্ছে। শরীর খারাপ করেনিতো ? মতিঝিল প্রান্তে নাহিদ চমকে উঠে। শেলী ডিওএইচএস থেকে কি করে বুঝল আজ তার মন খারাপ ? আজব এই দুনিয়াটা। মানুষের শরীরে মনের অস্তিত্ব কোথায় আছে আজ পর্যন্ত কোন বিজ্ঞানী বা চিকিৎসক খুঁজে বের করতে পারেনি। অথচ মনের বাহ্যিক রূপটা আজ পর্যন্ত কেউ গোপন রাখতে পারেনি।
সেল ফোনটা ভাইব্রেট দিচ্ছে। টেবিলের উপর রাখা কফির মগটা কাঁপছে। ল্যান্ডফোনে কথা বলা অবস্থায় নাহিদ ফোনের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। বুকের মাঝে যেন রক্ত ছলকে উঠছে। এ যে রুমকীর কল। হোয়াটস্যাপ এ কল দিয়েছে রুমকী। দ্রুত বিদায় জানানোর আগে শেলীর কাছে জেনে নিল, বাসায় ফেরার সময় হাড়িভাঙ্গা আমি নিয়ে বাসায় যেতে হবে। ছেলে মেয়েরা এই আম খেতে চেয়েছে।
স্মার্ট সেল ফোনে একটা ঘষা মারল নাহিদ। রুমকীকে কানেক্ট করল সে। প্রথমেই অনুযোগের সুরে রুমকী বলল, আজ একটু কাজ ছিল। ব্যস্ত ছিলাম। ব্যস্ততার মাঝেও ফোন কল করা যায়। কিন্তু ব্যস্ততা, কাজ নিয়ে চিঠি লেখা যায়না। বাসায় ফিরে খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে চিঠি লিখলাম। এখনো সেন্ড করিনি। কপি করে সেন্ড করব এখন। তুমি আমার চিঠি পড়তে থাকবে। এই ফাঁকে আমি ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু স্ন্যাক্স খাব। এরপরে কফির মগে চুমুক দিয়ে আবার তোমাকে কল ব্যাক করব। তখন কথা হবে চিঠি নিয়ে। তখন কথা হবে তোমার আমার কথা। তখন কথা হবে বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলার কথা। হুট্ করেই কল কেটে দিয়ে বিদায় নিল রুমকী। স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনের দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নাহিদ। এর মাঝে টুং শব্দ করে স্ক্রিনে ভেসে উঠল রুমকীর চিঠি। রুমকীর চিঠিটা ডেলিভারি দিল হোয়াটস্যাপ মেসেঞ্জার বক্স।
নাহিদ, ইদানিং আমি যে ফোনে কথা বলতে চাইনা তার কারণ তুমি কিন্তু জানো। কথাতো সব মনে রাখা যায়না। কিন্তু লেখা থেকে যায়। অন্তরে গেঁথে না গেলেও গেঁথে থাকে কাগজে বা ইনবক্সের জমিনে। কখনো ভালো লাগে সে কথা অথবা ভালো লাগেনা। কিন্তু বর্ণমালার গুচ্ছগাঁথা থেকে যায় সারাজীবনের জন্যে। যদি আমার এই লেখাগুলো সংরক্ষণ করতে পার, তাহলে ”নাহিদ-রুমকীর অসমাপ্ত কথোপকথন” এ কথার ভাটা পড়বে না কোনোদিন।
তোমার কি মনে আছে, তুমি আমি যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, তোমার একবার খুব জ্বর হলো। সে জ্বর নাকি আর সারেনা। তোমার নাকি যায় যায় অবস্থা। এই যায় যায় অবস্থার বর্ণনা শুনেছি আমি তোমার প্রেরিত দূত এর মাধ্যমে। কি যেন নাম ছিল তোমার রুম মেটের ? হ্যা মনে পড়ছে তোমার রুম মেটের নাম ছিল পিংকু। তোমাদের ডিপার্টমেন্টেই পড়তো। তোমার এক বছরের সিনিয়র। প্রিলিমিনারিতে পড়ত।
জানো, তোমার এই পিংকু কি ঘটনা ঘটিয়েছিল সেদিন ? তোমার অসুস্থতার কথা জানালো। আমিও এক নিমিষে বিশ্বাস করে ফেললাম। কারণ তোমাকে আমি ৭ দিন যাবৎ হন্যে হয়ে খুঁজেছি। ক্যাম্পাসের কোথাও আমি তোমাকে পাইনি। পিংকুর মুখে তোমার কঠিন জ্বরের কথা শুনে আমি তাকে বললাম, চলেন রিক্সায় যাই। কলা ভবন থেকে তোমার হলটা বেশ দূরে। তাছাড়া, হল প্রভোস্ট, হাউস টিউটর অথবা সিকিউরিটি গার্ডদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তোমার রুমে যেতে হলে পলাশী গেট দিয়েই যাওয়া উত্তম। কিন্তু তোমার বিশেষ দূত আমার সঙ্গে রিক্সায় উঠবে না। সে শুধু বার বার বলছে, হেঁটেই যাই।
এই জগতে কত মানুষের কত কিযে সমস্যা ! পরে তোমার মুখেই শুনেছি, পিংকু প্রেম করত তার এক বান্ধবীর সাথে। সেই বান্ধবী যদি কোন কারণ বসত দেখে ফেলত, তার পিংকু ক্যাম্পাসে রিক্সায় ঘুরছে আরেক মেয়ের সাথে। এই ভয়ে সে আর আমার সাথে রিক্সায় উঠেনি। কলা ভবন থেকে ভিসির বাসার সামনে দিয়ে ফুলার রোডে যখন হাঁটছি পিংকুর সাথে, তখন জানতে চাইলাম, আপনার বাড়ি কোথায় ? নির্লিপ্ত ভাবে পিংকু জবাব দিয়েছিল, আমার বাড়ি নিউইয়র্কে। আমি অবাক হয়ে পিংকুর দিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করে বলেছি, আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করেন ?
আমরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে তখন ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাছে পৌঁছেছি। পিংকু আবারো জোড় দিয়ে বলল, হ্যা আমার বাড়ি নিউইয়র্কে। বিশ্বাস না হলে চলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলে ঢুকে নিউইয়র্কের মানে খুঁজে বের করি। আমি রাগ করে বললাম পিংকুকে, ব্রিটিশ কাউন্সিল যেতে হবেনা। আপনার বাড়ি কোথায় এটা জানার জন্যে ডিকশনারি খুঁজতে পারবনা। পিংকু হাসি দিয়ে বলেছিল সেদিন, ইয়র্ক মানে গাঁ বা গ্রাম। নিউ মানে নতুন। তাহলে মানে কি দাঁড়ালো ? নতুন গ্রাম। এটাকে আরও কথ্য বাংলায় রূপ দিন, দেখবেন হয়ে গেছে নওগাঁ। নিউ ইয়র্ক মানে কি নওগাঁ নয় ?
আমি পিংকুর কথায় হেসে ফেলি। খুব ভালো বুদ্ধি করে নওগাঁকে নিউইয়র্ক বলে চালিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু গাঁজার অপবাদ দূর করবেন কেমনে ? পিংকু হেসে বলে এই অপবাদ দূর করার দরকার কি ? নওগাঁর ব্র্যান্ডিং নেম যদি হয় গাঁজার জেলা তাহলে মন্দ কি ? আল্লাহর দেয়া গাছের পাতার মাহাত্যে না হয় আমরা মহিয়ান হয়ে থাকলাম।
পিংকুর সাথে কথা বলতে বলতে আমি তোমার হলে পৌঁছে গেলাম। তোমার রুমে ঢুকে পড়লাম। দেখি, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ। কয়েকদিনের জ্বরে তুমি শীর্ণকায় হয়ে পড়েছ। তোমাকে দেখে আমার বুকের মাঝে যেন এক হাহাকার সৃষ্টি হল। বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলো জানালা গলিয়ে তোমার মুখে পড়েছে। আমি পরম মমতায় জানালাটা বন্ধ করে দিলাম।
সিস্টেমটা বোধ হয় তুমি আগেই ঠিক করে রেখেছিলে। পিংকু আমাকে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে কেক বিস্কুট আনতে পলাশী চলে গেল। আমি তোমার কপালে হাত দিলাম। জ্বরে তোমার কপাল পুড়ে যাচ্ছে। আমি তোমার মাথার ঘন চুলের মাঝে আঙ্গুল চালালাম। তোমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তুমি তোমার মাথা থেকে আমার হাতের তালুটা ভরে ফেললে তোমার হাতের তালুতে। আমার কি যে হল, তোমার এই অবস্থা দেখে আমি কেঁদে ফেললাম। তুমি আমার কান্না বন্ধে টেবিলে টুইন ওয়ানে প্লেয়ার বাটনটা টিপে দিলে। উননাসিক কণ্ঠে শচীনদেব বর্মন গেয়ে উঠল। গানের প্রথম অংশটা কেন জানিনা সেদিন আমার মন চাচ্ছিল আমিও গাই –
বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা
রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে এ কী তব হোরি খেলা
তুমি যে ফাগুন রঙের আগুন তুমি যে রসের ধারা
তোমার মাধুরী তোমার মদিরা করে মোরে দিশাহারা
মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে তেমনি আমাতে তুমি
আমার পরানে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি।
(চলবে)
লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।
কিউএনবি/নাহিদা/২৭.০৭.২০২৩/ রাত ১১.৪৫