রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৫:৫০ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম
পরিবারে সুখ ফেরাতে বিদেশে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন শার্শার রনি শার্শায় গৃহবধূকে গনধর্ষণের অভিযোগ কোম্পানীগঞ্জে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে তরুণের মৃত্যু মনিরামপুর প্রেসক্লাবের দাতা সদস্যের বোনের ইন্তিকাল মনিরামপুরে রশীদ বিন ওয়াক্কাসকে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা আটোয়ারীতে কিন্ডারগার্টেনের কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ও সনদপত্র বিতরণ পাঁচদোনা টু ডাঙ্গা চারলেন সড়ক অপরাধীদের অভয়ারণ্যে  চৌগাছায় শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের উল্টো রথযাত্রা অনুষ্ঠিত দৌলতপুরে প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আলহাজ্ব গিয়াস উদ্দিনের দাফন সম্পন্ন চৌগাছায় ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে বিএনপি নেতাকে পিটিয়েছে প্রতিবেশী পুলিশ সদস্য

কলাগাছের আঁশ থেকে কলাবতী শাড়ি ও একজন রাধাবতী দেবী

Reporter Name
  • Update Time : সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৩
  • ২০১ Time View

ডেস্ক নিউজ : রাধাবতী দেবী কদিন আগেও ছিল একটি অচেনা নাম। একটি শাড়ি তৈরি করে আজ ব্যাপক পরিচিতি নামটি। কলাগাছের তন্তু (সুতা) দিয়ে শাড়ি তৈরি নতুন এক উদ্ভাবন। এ উদ্ভাবনের পেছনে রয়েছেন দুজন নারীর চিন্তা ও কর্মতৎপরতা। একজন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি এবং অন্যজন কমলগঞ্জের রাধাবতী দেবী।

সম্প্রতি তাদের সাফল্যের (কলাগাছের সুতা দিয়ে শাড়ি তৈরি) গল্প ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র। ১৫ দিনের চেষ্টায় দেশে প্রথম বারের মতো কলাগাছের আঁশ থেকে তৈরি সুতা দিয়ে শাড়ি বুনেছেন রাধাবতী দেবী। ১২ হাত লম্বা এ শাড়িটি বুনন করে বাংলাদেশ তথা বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন। দৃষ্টিনন্দন শাড়ির নাম রাখা হয়েছে ‘কলাবতী’।

মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে কমলগঞ্জ উপজেলা সদর প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূর। সেখান থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে মণিপুরী জনগোষ্ঠীর গ্রাম ভানুবিল মাঝেরগাঁও। প্রায় ৬৫ বছর আগে সে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাধাবতী দেবী।

তিনি জানান, তার জন্মের কয়েক মাস পর তার বাবা মারা যান। ফলে মা মালতী দেবী হয়ে ওঠেন তার ভরসার জায়গা। কিছুদিন পর মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ফলে রাধাবতী বড় হন চাচার কাছে। স্থানীয় তেতইগাঁও রশিদ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার বিয়ে হয়ে যায়। সংসার জীবন শুরুর তিন মাস পর বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ২০১৬ সালে তার মাও মারা যান।

বিচ্ছেদ আর বিষণ্নতার মধ্যে রাধাবতী দেবী বয়ে চলেছেন ৬৬ বছরের জীবন। বর্তমানে চাচাতো ভাই অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক রণজিৎ সিংহের পরিবারে থাকেন। তিনিসহ রঞ্জিতের পরিবারের সদস্য ১০ জন। সাধ্যমতো কাজ করে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন রাধাবতী।

রাধাবতী জানান, পারিবারিক ঐতিহ্য হিসাবে ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি মণিপুরী তাঁতবস্ত্র তৈরি করছেন। ১৯৯২ সাল থেকে শাড়ি তৈরি শুরু করেন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে তিনিই প্রথম শুরু করেন তাঁতের তৈরি বস্ত্রগুলো। মাফলার, ওড়না, শাড়ি, গামছা, উত্তরীয়সহ বিভিন্ন পণ্য তিনি তৈরি করতেন। সেসব তৈরি পণ্য কিছু পাইকাররা বাড়িতে এসে নিয়ে যেতেন। পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন তাঁতবস্ত্র দোকানের চাহিদা এলেই তিনি সে হিসাবে মণিপুরী তাঁতবস্ত্র তৈরি করে দিয়ে থাকেন।

বাড়িতে টকটকি (তাঁতের কাঠের মেশিন) দিয়ে মণিপুরী বস্ত্র বুনন করেন। তাঁতবস্ত্র তৈরিতে ১৯৮৬ সালে প্রথম ভারতের মণিপুরের ইম্পলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। এরপর কমলগঞ্জের মাধবপুরে মণিপুরী ললিত কলা একাডেমিতে ২০১০ সালে ২ বার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সেই থেকে তিনি এখন মণিপুরী তাঁতবস্ত্র বুননে এলাকায় একজন ওস্তাদ (গুরু) হয়ে গেছেন।

মণিপুরী তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী এক সময় সিলেট অবস্থান করায় সেখানে মীরা বাজার এলাকায় সমবায় অফিসের তাঁতবস্ত্র বুননের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখন নিজ এলাকার অনেক মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে বস্ত্র বুনন উদ্যোক্তা বানিয়েছেন। যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তারা আজ সফল হয়েছেন বলে জানান রাধাবতী দেবী। রাধাবতীর ফুফাতো ভাই গুনমনির বান্দরবান এলাকায় কাজ করেন। গুনমনির মাধ্যমে রাধাবতী দেবীর দক্ষতার খোঁজ পান বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি।

বান্দরবন জেলার জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি কয়েক মাস আগে কমলগঞ্জ থেকে তাকে নিয়ে যান বান্দরবনে। তাকে দেখানো হয় কলাগাছের আঁশের সুতায় তৈরি ব্যাগ, জুতা, পাপোস, ফুলদানি, ফাইল কভার, কলমদানিসহ হস্তশিল্প সামগ্রী। পাশাপাশি রাধাবতীকে বলা হলো কলাগাছের সুতা দিয়ে একটি শাড়ি বুনন করে দিতে।

প্রথমে চিন্তায় পড়ে গেলেও এ সুতোয় অন্যান্য হস্তশিল্প বুনন সম্ভব হলে শাড়ি কেন সম্ভব নয়-এ প্রশ্ন নিজের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করায় মনের জোরে ও সাহসে তিনি রাজি হয়ে গেলেন। কলাগাছের কিছু সুতা সঙ্গে এনে কমলগঞ্জে নিজ বাড়িতে তাঁত সুতার সঙ্গে কলাগাছের সুতা মিশিয়ে প্রথমে একটি ওড়না বুনন করেন। 

এরপর নিজ বাড়ি থেকে তাঁতের সুতা সঙ্গে নিয়ে বান্দরবান গিয়ে শুরু করেন শাড়ি বুনন। এক কেজি কলার সুতার সঙ্গে তাঁত সুতার সংমিশ্রণ করে টানা ১৫ দিনে কলার সুতার শাড়ি বুনন করে চমকে দিলেন সবাইকে। বান্দরবন জেলার জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজিও এ উদ্যোগে সফল হলেন বলে মণিপুরী তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী মনে করেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীতে আরও কম সময়ে ও কম খরচে আরও মসৃণ ও উন্নতমানের শাড়ি তৈরি করা সম্ভব হবে।

বান্দরবান জেলার জেলা প্রশাসক তাকে দিয়ে আরও কয়েকটি শাড়ি তৈরির চিন্তা করেছেন বলে তাকে জানিয়েছেন। এমনকি তাকে দিয়ে কলার সুতার শাড়ি তৈরির একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করার মনোভাবও তিনি প্রকাশ করেন।

রাধাবতী দেবীর সাফল্যে মণিপুরী সমাজ ও কমলগঞ্জ তথা মৌলভীবাজার জেলাবাসী গর্বিত ও আনন্দিত। মণিপুরী সমাজের ঘরে ঘরে এখন আনন্দের বন্যা বইছে। ৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল মাঝেরগাঁও গ্রামে ইন্দো বাংলা এবং ভানুবিল মাঝেরগাঁও কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজমের উদ্যোগে রাধাবতী দেবীকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।

কলাগাছের সুতা থেকে শাড়ি তৈরির পেছনে রয়েছে একটি প্রকল্পের দীর্ঘদিন ধরে নীরবে কাজ করে যাওয়ার গল্প। সেই প্রকল্পটি হলো কলাগাছের আঁশ থেকে বানানো সুতায় হস্তশিল্প তৈরি। এর নেপথ্য কারিগর বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। ২০২১ সাল থেকে কলাগাছের তন্তু দিয়ে হস্তজাত শিল্প তৈরির এ পরীক্ষামূলক প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে।

অফিস-আদালত বা সভা-সেমিনারে ব্যবহারের জন্য ফোল্ডার, ঝুড়ি, শতরঞ্জি, কলমদানি, পাঁচ তারকা হোটেলের কক্ষে পরার জন্য জুতাসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে কলাগাছের তন্তু দিয়ে। তবে শাড়ি কেন নয়!

এ চিন্তা থেকে এ বছরের শুরুতে শাড়ি তৈরির প্রশিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় রাধাবতী দেবীকে। শাড়ি বানানোর জন্য মৌলভীবাজার থেকে তাঁতও আনা হয়। ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, ‘দক্ষ তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবীকে আমরা সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়েছি শাড়িটি তৈরি করতে। এ জন্য তাকে স্মরণ রাখতে শাড়ির নাম দিয়েছি ‘কলাবতী’। কলাগাছের ‘কলা’ আর রাধাবতীর ‘বতী’ যোগ করে নির্ধারণ করা হয়েছে এ নাম। কলাগাছের সুতা থেকে তৈরি শাড়িটি অনেকটা মণিপুরী ও জামদানি শাড়ির মতো। অথবা এ দুই শাড়ির মাঝামাঝি।’

ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি আরও জানান, সুতাকে কতটা নমনীয় করা যায়, কীভাবে আরও বেশি সুতা উৎপন্ন করা যায় এসব নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা হওয়া দরকার। সে কারণে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, তাঁত বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় চিঠি পাঠানো হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কারিগরের মজুরিসহ শাড়ির দাম চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা হবে।

রাধাবতী দেবী বলেন, ‘কলাবতী শাড়ি তৈরির পর বান্দরবান জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে আমাকে অর্থসহায়তা এবং একটি স্মার্টফোন উপহার দেওয়া হয়। তবে উপহার আর মজুরির চেয়ে আমার কাছে আনন্দের বিষয় হলো দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছি।’ এ জন্য সরকার, বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ও ফুফাতো ভাই গুনমনির কাছে ঋণী বলে জানান রাধাবতী দেবী।

উদ্যোগ সফল হলে ভালো লাগে সবার। রাধাবতী দেবী কিংবা ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির দুজনই খানিকটা তৃপ্ত। তারা জানান, কাজটি এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। এখান থেকে স্থানীয় মানুষ যাতে লাভবান হয়, সে পথ খুঁজে বের করতে হবে।

কিউএনবি/অনিমা/১০ এপ্রিল ২০২৩,/দুপুর ১:০৮

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

July 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit