ডেস্ক নিউজ : জ্বালানি তেল ও গ্যাসসংকটের কারণে প্রতিদিন দুই থেকে চার ঘণ্টার লোড শেডিংয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। উৎপাদন খরচ বাড়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন শপিং মলসহ সব ধরনের দোকান রাত ৮টার পর বাধ্যতামূলকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়।
এর বিরূপ প্রভাবও পড়েছে ওই এলাকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের ওপর। রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকার ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে দেলওয়ার মেটাল এন্টারপ্রাইজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বাসাবাড়ির স্টিলের গেট, দরজা, জানালা, গ্রিল তৈরি করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের হেড মিস্ত্রি মো. স্বপন বলেন, ‘প্রতিদিন তিন-পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় কাজ অনেক কম হচ্ছে। আমাদের কাজই বিদ্যুতের। রড কাটা, ছিদ্র করা, জোড়া লাগানোসহ সব কাজ বিদ্যুৎ নির্ভর। বিদ্যুৎ না থাকলে কাজ বন্ধ। ’
তিনি বলেন, ‘যখন হরদম বিদ্যুৎ থাকত তখন মাসে এক থেকে তিন লাখ টাকার অর্ডারের কাজ করা সম্ভব ছিল। এখন তা ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখে নেমে এসেছে। ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। অন্যদিকে আবার বিদ্যুৎ ঠিকমতো থাকছে না। আগে যখন সব সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকত, তখন তিন লাখ টাকার কাজ এক সপ্তাহের মধ্যে ডেলিভারি দিতে পারতাম। এখন সেই কাজে ১৫ থেকে ২০ দিন লেগে যাচ্ছে। এখন পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লোড শেডিং দেয়। ’বিদ্যুৎ না থাকায় শ্রমিকদের কাজের পরিমাণ কমে গেছে। এতে চুক্তিভিত্তিক যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তাঁদের আয়ও কমে গেছে।
নিউ মার্কেটের গাউছিয়া বিপণিবিতান কেন্দ্রের তৃতীয় তলায় আল ইমন গার্মেন্টের প্রতিষ্ঠানে সব বয়সী নারীর সব ধরনের থ্রিপিস তৈরি করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার আব্দুল আজিজ ছাড়া ছয়-সাতজন শ্রমিক চুক্তিতে কাজ করেন। কালের কণ্ঠকে আজিজ বলেন, ‘শুধু আমিই এখানে বেতনভুক্ত। বাকিদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয় প্রডাকশনের ওপর নির্ভর করে। প্রতিদিন তিন-চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। আবার ৮টার সময় মার্কেট বন্ধ করে দিতে হয়। এতে আমাদের পোশাক তৈরি অর্ধেক কমে গেছে। আগে প্রতিদিন ১০০ পিস তৈরি করতে পারতাম, এখন সর্বোচ্চ ৬০ পিস করা যাচ্ছে। কারণ আগে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত কাজ করা যেত, এখন রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আবার দিনের মধ্যে প্রায় চারবার বিদ্যুৎ চলে যায়। ফলে যারা চুক্তিতে কাজ করে, তারা আগে ১২০০ টাকা আয় করতে পারত। এখন তারা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা পাচ্ছে। অন্যদিকে মালিকেরও ক্ষতি হচ্ছে। কারণ সামনে ঈদ আসছে। ’
আব্দুল আজিজ বলেন, ‘১২ বছর ধরে কাজ করছি। ঈদের আগে এ রকম সময় থেকে মাল তৈরি করে স্টক করা শুরু করি। এ বছর তা আর হচ্ছে না। যা তৈরি করছি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আবার উৎপাদনও কম হচ্ছে। দোকানের ভাড়া কিন্তু ঠিকই দিতে হচ্ছে। ফলে ঈদের সময় যে কিছুটা লাভে বিক্রি করা যায়, তা এ বছর হবে বলে মনে হয় না। ’ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদনের সঙ্গে নির্ভর করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের লাভ-ক্ষতি। যদি উৎপাদন বেশি হয় তাহলে খরচ কমে যায়। উৎপাদন কম হলে খরচ বেড়ে যায়। এতে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন।
নীলক্ষেতের আর কে ট্রেডার্সে সব ধরনের লিফলেট, ব্যানার, পোস্টার প্রিন্টিংয়ের কাজ করা হয়। পুরোপুরি উৎপাদনমুখী ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. আব্দুল লতিফ বলেন, ‘ধরুন, আগে প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকার প্রিন্টিংয়ের কাজ হতো, এখন তা দুই থেকে তিন হাজারে হচ্ছে। আমাদের ব্যবসা বিদ্যুৎ ছাড়া সম্ভব না। বিদ্যুৎ না থাকলে সব বন্ধ। উৎপাদন বন্ধ থাকলেও ঘরভাড়া, শ্রমিকদের বেতন মাসিক ভিত্তিতে কিন্তু দিতেই হয়। অথচ উৎপাদন হচ্ছে কম। কালি-কাগজের দাম বেড়েছে। যে ব্যবসা হচ্ছে তাতে এখন ঘরভাড়া দেওয়াই কঠিন। গত ছয় মাসের ভাড়া বাকি। তার পরও মালিক আমাদের সুযোগ দিচ্ছেন যে ব্যবসা ভালো হলে ভাড়া দিতে পারব। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। ’
বিদ্যুত্সংকটের কারণে শুধু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নয়, সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন বলে মনে করেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের গত কয়েক বছরের উন্নয়নের প্রধান কারণই ছিল বিদ্যুত্সংকট না থাকা। লোড শেডিংয়ের জন্য কিছু সাশ্রয় হচ্ছে, কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকার কারণে যে মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, তার দায়ভার কে নেবে? সারা দিন বিদ্যুৎ যাচ্ছে-আসছে। দোকান রাত ৮টায় বন্ধ করা লাগছে। তো কাস্টমার আসবে কখন? যেভাবেই হোক সরকারকে দ্রুত চিন্তা করতে হবে এই সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যায়। না হলে গত ১০-১২ বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে, সেটা কিন্তু টেকসই উন্নয়ন হিসেবে থাকবে না। এবং আমাদের বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে। ’
কিউএনবি/আয়শা/১৩ অক্টোবর ২০২২,খ্রিস্টাব্দ/সকাল ১১:৪৫