এম এ রহিম চৌগাছা (যশোর) : যশোরের চৌগাছায় এবিসিডি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের স্ত্রীকে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ দিতে নানা জালিয়াতির অভিযোগে তাকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। স্ত্রীকে নিয়োগ দিতে সার্টিফিকেট জালিয়াতি, নিয়োগ বোর্ডের রেজুলেশন জালিয়াতি, রেজুলেশনে ফ্লুইড দিয়ে পদের নাম পরিবর্তন, ভুয়া নিয়োগ দেয়া, তথ্য গোপন করে মানথলি পেমেন্ট অর্ডারভূক্ত (এমপিওভূক্ত) করানোসহ নানা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় প্রধান শিক্ষক শাহাজাহান কবিরকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।রবিবার বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। একইসাথে অভিযোগ তদন্তে উপজেলার জেএইচডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আরিফুল ইসলাম তুহিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অভিযুক্ত শাহাজাহান কবীর উপজেলার হাকিমপুর ইউনিয়নের (আরাজিসুলতানপুর-বকসীপুর-মাঠচাকলা-দেবীপুর) এবিসিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আর জালিয়াতি করে নিয়োগ পাওয়া মোছাম্মাৎ খাদিজা খাতুন তার স্ত্রী। এছাড়াও একইভাবে জালিয়াতি করে সুমন মন্ডল নামে আরেক সহকারী শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। রবিবার বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষিকারা বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির নিকট লিখিত অঙ্গীকারনামা দিয়ে বলেছেন, আমরা মে-২০২২ সালের এমপিও সিট দেখে জেনেছি মোছাম্মাৎ খাদিজা খাতুন এবং সুমন মন্ডল নামে দুই জন শিক্ষক এমপিওভূক্ত হয়েছে। আমরা পূর্বে কখনো তাদের বিদ্যালয়ে দেখিনি, চিনিওনা এমনকি শিক্ষক হাজিরা খাতায় তাদের স্বাক্ষও নেই।
বিদ্যালয়টির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও হাকিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুদুল হাসান বলেন,নিয়োগ ও এমপিওভূক্তির বিষয়টি স¤পূর্ণ জালিয়াতি করে আমার অগোচরে করা হয়েছে। আমার নিকট মে-২০২২ মাসের বেতন বিলে স্বাক্ষর করতে গেলে বিষয়টি প্রথমে আমার চোখে পড়ে। পরে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি স্বাক্ষর জালিয়াতি করে তিনি নিজের স্ত্রী এবং অন্য একজনকে নিয়োগ দিয়ে বেতনও কওে এনেছেন। আজ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় তাকে সাময়িক অব্যহতি দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া জালিয়াতি করে নিয়োগ পাওয়া দুই শিক্ষককের নাম বাদ দিয়ে বেতন বিলে স্বাক্ষর করা হয়েছে।
উল্লেখ্য এর আগে ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যাবতীয় তথ্যপ্রমাণসহ মাঠচাকলা গ্রামের মামুন কবির নামে এক ব্যাক্তিযশোর জেলা প্রশাসকের নিকট ওই প্রধান শিক্ষক ও তার স্ত্রী মোছাম্মাৎ খাদিজা খাতুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেন। আবেদন ও তথ্যপ্রমাণের অনুলিপি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর, ঢাকা, যশোর জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার দপ্তরে দেন তিনি।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী খাদিজা খাতুন ১৯৯২ সালে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে ২য় বিভাগে দাখিল পাশ করেন, ১৯৯৫ সালে যশোর বোর্ড থেকে তিনি ২য় বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (পাশ) করেন ২০০৫ সালে। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে বিএড পাশ করেন। অথচ ২০০২ সালের ২৪ ডিসেম্বর এবিসিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমানের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে খাদিজা খাতুনকে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগপত্র দেয়া হয়। সেই নিয়োগপত্রের সূত্র ধরে ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারী তিনি বিদ্যালয়ে যোগদান করেন মর্মে যোগদানপত্র রয়েছে এবং নিয়োগপত্র ও যোগদানপত্রে খাদিজা খাতুনের পিতার ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে দেয়া বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক শাহজাহান কবীর স্বাক্ষরিত শিক্ষক/কর্মচারী তথ্য ছকে খাদিজা খাতুনকে সহকারী শিক্ষিকা (ইংরেজি) হিসেবে ননইনডেক্সধারী (নন এমপিওভূক্ত) শিক্ষক হিসেবে দেখানো হয়।
সেখানে খাদিজা খাতুনকে ২০০১ সালে বিএ পাশ দেখিয়ে বিদ্যালয়ে যোগদানের তারিখ দেখানো হয়েছে ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারী। সেখানে আরো দেখানো হয়েছে খাদিজা খাতুন এসএসসি পাশ করেছেন ১৯৯২ সালে। ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারী তারিখেই বর্তমান প্রধান শিক্ষক শাহাজান কবীরের স্বাক্ষরিত আরেকটি তথ্য ছকে একই শিক্ষক খাদিজা খাতুনকে কোন বিষয় উল্লেখ না করে শুধুমাত্র সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর যোগদানকৃত হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই তথ্য ছকেও খাদিজাকে ২০০১ সালে বিএ পাশ এবং ১৯৯২ সালে এসএসসি পাশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ অন্য যেসব শিক্ষক মাদরাসা বোর্ড থেকে দাখিল পাশ করেছেন তাদের দাখিল পাশ হিসেবেই দেখানো হয়েছে।
২০২২ সালের মে মাসের এমপিও সিটে (মানথলি পেমেন্ট অর্ডার) দেখা যাচ্ছে ২০১৫ সালের নিয়োগ দেখিয়ে খাদিজা খাতুনকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। গত মে-২০২২ সালের এমপিও সিটে খাদিজা খাতুনকে সহকারী শিক্ষক (বাংলা) হিসেবে এমপিও ইনডেক্স দেখানো হয়েছে এন-৫৬৮২১৯৭২। অথচ প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী খাদিজা খাতুন বিদ্যালয়ে কখনো ক্লাস করেননি। একইভাবে বিদ্যালয়ে কখনো ক্লাস না করা জনৈক সুমন মন্ডলকে জালিয়াতি করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার মে-২০২২ মাসের এমপিও সিটে ইনডেক্স দেখানো হয়েছে এন-৫৬৮২১৯৭৩। তাকে সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে দেখানো হয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলেছেন এই দুইজনের কাউকেই তারা চেনেন না এবং তারা কোনোদিন বিদ্যালয়ে আসেননি। শিক্ষক হাজিরা খাতায় তাদের কোনো স্বাক্ষরও নেই। শিক্ষকদের এই দাবি সভাপতির উপস্থিতিতে রবিবার বিদ্যালয়ে হাজিরা খাতা দেখে এই প্রতিবেদক নিশ্চিত হয়েছেন। এ ছাড়াও প্রধান শিক্ষক শাহাজান কবীর কয়েক বছর আগে ছাত্রীর শ্লীলতাহানীর অভিযোগে অভিযুক্ত হন। প্রমাণিত হওয়ার পরেও সেসময় ক্ষমা চেয়ে তিনি পার পেয়ে যান। এছাড়া তার বিরুদ্ধে মোটা টাকার বিনিময়ে পূর্বের তারিখে ৮ম ও দশম শ্রেণির সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর খাদিজার নিয়োগ বোর্ডের রেজুলেশনে বোর্ড উপজেলাশিক্ষা অফিসে দেখানো হয়েছে। সেখানে বিদ্যালয়ের সভাপতি ও হাকিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল হাসান, ডিজির প্রতিনিধি হিসেবে যশোর জিলা স্কুলের শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ওয়াহেদুজ্জামান, অভিভাবক সদস্য জমশের আলী এবং প্রধান শিক্ষক শাহাজান কবীরকে উপস্থিত দেখানো হয়েছে। সেই রেজুলেশনের প্রথম পাতায় লেখা হয়েছে অদ্য ইং ২৫/০৯/২০১৫ তারিখে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার চৌগাছা যশোর এর কার্যালয়ে এবিসিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি জনাব মোঃ মাসুদুল হাসান সাহেবের সভাপতিত্বে একজন সহকারী গ্রন্থাগারিক পদে নিয়োগের নিমিত্তে এক নিয়োগ বোর্ড অনুষ্ঠিত হয়। নিয়োগ বোর্ডের সকল সদস্যের সম্মতিক্রমে লিখিত ৩০, মৌখিক ১১ ও সনদপত্রে ০৯ মোট ৫০ নম্বরের মধ্যে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। লিখিত পরীক্ষায় (০৪) চারজন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। রেজুলেশনের অপরপাতায় সভার তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর দেখানো হলেও স্থান দেখানো হয়েছে যশোর জেলা স্কুল, যশোর। এই পাতায় ফ্লুইড দিয়ে (ঘষামাজা করে) লেখা মোছাম্মাৎ খাদিজা খাতুন, স্বামী মোঃ শাহাজাহান কবীর প্রথম হওয়ায় তাকে সহকারী শিক্ষক সামাঃবিঃ (ঘষামাজা করে লেখা) পদে নিয়োগের জন্য বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদকে সুপারিশ করা হলো।
এদিকে অভিযোগ করার পরপরই ওই প্রধান শিক্ষকের পক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তি মামুন কবীরকে ম্যানেজ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন বলে অভিযোগ করেছেন মামুন কবীর। তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে এরইমধ্যে আমাকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে বিষয়টি চেপে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।এ ব্যাপারে নিয়োগ দেখানো শিক্ষিকা খাদিজা খাতুনের নিকট মোবাইলে জানতে চাইলে, আপনি কি এবিসিডি স্কুলে ২০০২ সালে নিয়োগ পেয়েছিলেন? তিনি বলেন, হ্যা। আপানার কি এমপিওভূক্তি হয়েছে প্রশ্নে তিনি বলেন, না। আপনি কি ২০১৫ সালে ফের ওই স্কুলে নিয়োগ পেয়েছেন প্রশ্ন করার পরই চুপ হয়ে যান। ফোন রিসিভ করেই রেখে দেন। তবে এরপর একাধিকবার কল করা হলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।প্রধান শিক্ষক শাহাজান কবীরের নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেন নি। রবিবার সকালে বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেখা যায়, বিদ্যালয় খোলার আগেই প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের অফিস খুলে হাজিরা খাতায় নিজের স্বাক্ষর করে চলে গেছেন।২০০২ সালে খাদিজা খাতুনের নিয়োগের বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, আমার সময়ে খাদিজা খাতুন নামে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমার স্বাক্ষরে যে নিয়োগপত্র দেখানো হয়েছে তা স¤পূর্ণ ভুয়া। এমনকি আমার স্বাক্ষরও জাল। এ বিষয়ে আমাকে যেখানে যেয়ে স্বাক্ষী দেয়ার জন্য বলা হবে, আমি দিতে প্রস্তুত আছি।চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে দেয়া হবে। অনিয়ম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কিউএনবি/অনিমা/১৯.০৬.২০২২ খ্রিস্টাব্দ/দুপুর ১:৫৮