ডেস্ক নিউজ : করোনা মহামারিতে বিগত কয়েকটি ঈদ কেটেছে নানা বিধি-নিষেধে। এবার সেটা অনেকটাই শিথিল। তাই প্রাণ খুলে ঈদ উৎসবে মেতে উঠেছিল রাজধানীবাসী। ঈদের আগে ঢাকায় অসহ্য গরম থাকলেও ঈদের দিনের আবহাওয়া ছিল ঘোরাঘুরির জন্য অত্যন্ত অনুকূল। প্রকৃতি ও পরিবেশের সমর্থন পেয়ে ঈদের দিন বিকেল থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত খোলা জায়গা, লেক, পার্ক, জাদুঘর আর জাতীয় চিড়িয়াখানায় মানুষের ছিল উপচে পড়া ভিড়। চিড়িয়াখানায় তিন দিনেই তিন লাখ দর্শনার্থীর আগমন ঘটে।
ঈদের দিন দুপুরের পর থেকেই রাজধানীর হাতিরঝিল, রমনা পার্ক, শিশু পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, কার্জন হল, ধানমণ্ডি লেক, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা, চন্দ্রিমা উদ্যান, বিমানবাহিনী জাদুঘর ও মিরপুর চিড়িয়াখানায় ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে। ঈদের দিন সন্ধ্যায় গুলশান ১ নম্বর সড়কের গোল চত্বরে ওহিদুল ইসলাম ও লিলিমা ইসলাম দম্পতির সঙ্গে আলাপ। ২৫ বছরের বেশি পুরনো তাঁদের দাম্পত্য জীবন। বাসায় পরিবারের অন্যদের রেখে দুজন বেরিয়ে পড়েছেন। খোলা রিকশায় বসে ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় অনেকক্ষণ দুজনে ঘুরেছেন। নানা রাস্তা ঘুরে গুলশান সোসাইটি লেক পার্কে কিছু সময় বসে প্রকৃতি উদযাপন করেছেন। লিলিমা ইসলাম জানালেন, আজকের মতো এটিই ঈদ উদযাপন। আগামীকাল হয়তো পরিবারের সবাইকে নিয়ে ধারে-কাছে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হবে। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে ঈদের দিন ও ঈদের দ্বিতীয় দিনেও অনেককে সেজেগুজে রিকশায় ঘুরতে দেখা গেছে। তবে বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে সময় কাটিয়েছে সবচেয়ে বেশি মানুষ।
গতকাল ঈদের তৃতীয় দিন পর্যন্ত হাতিরঝিল এলাকায় ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি মানুষের ভিড়। হাতিরঝিলের গুলশান-গুদারাঘাট এলাকা থেকে মধ্যবাড্ডা, রামপুরা, মহানগর আবাসিক এলাকা, বিএফডিসি, তেজগাঁও ও পুলিশ প্লাজা অংশে বন্ধুবান্ধব ও পরিবার-পরিজন নিয়ে হাজার হাজার মানুষ সময় কাটিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভিড় ছিল ঈদের দিন ও ঈদের পরদিন বিকেলে। এ সময় দর্শনার্থীরা ওয়াটার ট্যাক্সি করে হাতিরঝিলে চক্কর দিয়েছে। কেউ কেউ ছোট ছোট নৌকা ভাড়া নিয়ে নিজেরাই তা চালিয়ে আনন্দ কুড়িয়েছে। হাতিরঝিলের চারপাশেই এখন গ্রীষ্মের ফুল কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর জারুল সৌন্দর্য বিলিয়ে দিচ্ছে। দর্শনার্থীরা প্রিয় মানুষ নিয়ে এমন সুন্দর পরিবেশ ক্যামেরাবন্দি করতে ভোলেনি। অনেকে মুঠোফোনে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের আনন্দের মুহূর্তটি ছড়িয়ে দিয়েছে সবার মাঝে।
ঈদের দ্বিতীয় দিন বিকেলে রাজধানীর রমনা পার্কে গিয়ে দেখা যায় এক উৎসবমুখর পরিবেশ। মৃদুমন্দ বাতাস আর লাল কৃষ্ণচূড়া এখানেও পরিবেশটাকে বেশ রাঙিয়ে তুলেছে। ছোট ছোট শিশুরা লাল-নীল বেলুন হাতে নিয়ে মা-বাবার হাত ধরে হাঁটছে, খেলছে। অনেকে এসেছে সপরিবারে। চাদর বিছিয়ে ঘাসের গালিচায় বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তবে লেকের ওপর বানানো হাঁটা রাস্তায় অনেক ভিড় ছিল এদিন। লেকের ওপর দাঁড়িয়ে তরুণ-তরুণীরা ছবি তুলছিল। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও কার্জন হলের চারপাশেও ছিল প্রায় একই রকম দৃশ্য। গতকাল ঈদের তৃতীয় দিনে বিজয় সরণি থেকে চন্দ্রিমা উদ্যান পর্যন্ত সড়কে বিকেল ৩টার পর থেকেই ছিল মানুষের বেশ ভিড়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটারের সামনে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। দর্শনার্থীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে রাজধানীর মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় ঈদের দিন মঙ্গলবার থেকে গতকাল পর্যন্ত দর্শনার্থী ছিল প্রায় তিন লাখ। এর মধ্যে গতকাল প্রায় এক লাখ ১০ হাজার দর্শনার্থী এসেছে, বুধবার এসেছে এক লাখ ২০ হাজার এবং এর আগে ঈদের দিন মঙ্গলবার বৃষ্টির মধ্যেও প্রায় ৬০ হাজার দর্শনার্থী এসেছে। ওই দিন মূলত সকাল ৯টা থেকে চিড়িয়াখানা খুললেও বৃষ্টির কারণে দুপুরের পর চিড়িয়াখানায় ভিড় বাড়তে শুরু করে। চিড়িয়াখানার তথ্য কর্মকর্তা মো. ওয়ালিউর রহমান বলেন, অন্যান্য সাধারণ সময়ে সরকারি ছুটির দিন চিড়িয়াখানায় প্রায় ২০ হাজার দর্শনার্থী আসে। তবে ঈদের দিন এ সংখ্যা ৬০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর পরে গত দুই দিনও লাখ ছাড়িয়ে যায়।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর দূর-দূরান্ত থেকে চিড়িয়াখানায় এসেছে বিভিন্ন বয়সের দর্শনার্থী। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এসেছে অনেকে। চিড়িয়াখানায় ঢুকতে হাতের বাঁ দিকে হরিণের খাঁচা। হরিণের বাচ্চার ছোটাছুটি মোবাইল ফোনে বন্দি করেছে দর্শনার্থীরা। আরেকটু এগিয়ে গেলেই বানরের খাঁচা। এ খাঁচার সামনে ছিল শিশুদের ভিড়। নিষেধ থাকলেও অনেককে বানরের উদ্দেশে বাদাম ছুড়তে দেখা গেছে। ময়ূরের খাঁচার সামনেও ছিল দর্শনার্থীর ভিড়। ময়ূরের পাখা মেলার দৃশ্য উচ্ছ্বাসিত করে দর্শকদের। এ ছাড়া লায়ন, জিরাফ, ইমু পাখির খাঁচার সামনেও ছিল ভিড়।
লালবাগ এলাকা থেকে লেগুনাচালক সামসুদ্দিন স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন দুপুর ১২টার দিকে। বিকেলে বাসায় ফেরার সময় তিনি বলেন, বাঘ, সিংহ, হরিণ সব দেখেছে বাচ্চারা। অনেক দিন পর বেড়াতে পেরে খুব ভালো লাগছে। তবে দর্শনার্থী বেশি হওয়ায় ছেলেমেয়েকে প্রাণীগুলো দেখাতে একটু বেগ পেতে হয়েছে। রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে এসেছেন তাসফিয়া ও তাঁর কলেজের বন্ধু-বান্ধবীরা। দুপুরের দিকে তাসফিয়া জানান, ‘সকলে মিলে ঠিক করলাম, আমরা ঈদ-পরবর্তী চিড়িয়াখানায় ঘুরব। তাই চলে এলাম। ঘুরে বেশ ভালো সময় উপভোগ করছি। ’
চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. মুজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদ বিনোদনের কথা মাথায় রেখেই চিড়িয়াখানায় নেওয়া হয়েছে বাড়তি প্রস্তুতি। চার স্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নতুন করে দর্শনার্থীদের জন্য সুপেয় খাবার পানি ও হাত-মুখ ধোয়ার পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া টিকিট কাউন্টার, হাঁটার পথ, বসার জায়গা, খাবার স্থানসহ সব জায়গাই পরিষ্কার করে রং করা হয়েছে। দর্শনার্থী সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যা ধারণা করেছিলাম তার থেকে অনেক বেশি দর্শনার্থী আসছেন। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে লোকাল পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কাজ করছেন। ’
কিউএনবি/আয়শা/৬ই মে, ২০২২/১৮ বৈশাখ, ১৪২৯/দুপুর ১২:১৯