সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:০৯ পূর্বাহ্ন

হঠাৎ সয়াবিন তেল ‘উধাও’

Reporter Name
  • Update Time : সোমবার, ২ মে, ২০২২
  • ১১৮ Time View

ডেস্কনিউজঃ ঈদের আগে হঠাৎ মুদির দোকানে সয়াবিন ও পাম তেল পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি বিক্রেতাদের দাবি, তারা স্বাভাবিকভাবেই বাজারে তেল বিক্রি করছেন। তাই খুচরা দোকানে ভোজ্য তেলের ঘাটতির খবরে তারাও বিস্মিত।

ঢাকার দিলু রোডে ঢোকার মুখে দুই সারিতে ১০টির বেশি মুদি দোকান। একটু দূরেই বড় সুপারশপ। রাস্তার আরেক প্রান্তে, আরও কিছু দোকান। কিন্তু কোথাও সয়াবিন তেল পেলেন না বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা। রবিবার দুপুরে যখন শুনলেন তেল নেই, তখন তিনি অফিসে যাবার পথে কিনে দিয়ে যাবেন জানিয়ে বাসা থেকে বের হন। তাদের অফিস সবসময়ই খোলা থাকে; ছুটির মধ্যে ডিউটি পড়েছে তাই এদিনও যেতে হচ্ছে তাকে। তাড়া থাকায় কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই অফিসের পথে রওনা দেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তাহির মাহমুদ।

এগুলোর কোনোটিতেই সয়াবিন তেল না পেয়ে তিনি কয়েক কিলোমিটার দূরে অফিসের কাছে মহাখালী বাণিজ্যিক এলাকার দোকানগুলোতেও ঢু দিলেন পরিস্থিতি বুঝতে। সেখানেও একই কথা দোকানিদের সয়াবিন নাই, কোথাও কেউ তেল দিচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে বাসায় ফোন করে কথা বললেন বিকল্প নিয়ে। অফিসে ঢুকে চালডাল, পান্ডামার্ট, মিনাক্লিকের মত অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও বোতলজাত সয়াবিনের খোঁজ চালালেন; তবে মিলল না। চালডালে শুধু পলিব্যাগের সয়াবিন পাওয়া গেল- তাও এক লিটারের বেশি দেবে না বলে জানাল কর্তৃপক্ষ।

ঈদের আগে এবার সত্যিই চিন্তাতেই পড়লেন তিনি। খোঁজ নিলেন আরও দুয়েক জায়গায়। তার আত্মীয় থাকেন রামপুরার বনশ্রীতে। সেখানেও সয়াবিন নেই বলে খবর এল। শেষে পান্ডামার্ট থেকে সূর্যমুখী তেল কিনলেন সয়াবিনের প্রায় দ্বিগুণ দামে। ঈদ সামনে বলে অপেক্ষারও উপায় নেই।

এভাবেই তেলের খোঁজে ঘণ্টাখানেকের অবাক করা অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন তাহির মাহমুদ। তিনি বলেন, দিলু রোডের দূরত্ব রাজধানীর অন্যতম প্রধান পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজার থেকে কাছেই। ডিলাররা তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে এ এলাকার দোকানিদের অনেকেই নিজে থেকে কারওয়ান বাজার থেকে তেল এনে বেশ কয়েকদিন বিক্রি করেছেন। তবে গত কয়েকদিন তারা সেখানেও তেল পাননি। তাহিরকে এসব কথা বলেছেন দিলু রোডের দোকানি মেহেদি ইসলাম; যার কাছ থেকে তিনি নিয়মিত কেনাকাটা করে থাকেন।

ঈদের দুদিন আগে রবিবার এ চিত্র শুধু দিলু রোডের খুচরা দোকানের নয়; ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ মুদি দোকানের। ছোট বড় সব মুদি দোকানেই সয়াবিন ও পাম তেলের দেখা মিলছে না; ঈদের বাজার করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা। যারা আগে তেল কেনেননি তাদের অনেককে বিভিন্ন বাজারে তেলের জন্য এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ছুটতে দেখা গেছে। হঠাৎ করে তেল উধাও হয়ে যাওয়ায় উপায় না দেখে অনেকেই বেশি দাম দিয়ে সরিষা, রাইস ব্রান কিংবা সূর্যমুখী তেল কিনতে বাধ্য হয়েছেন।

রবিবার বিভিন্ন মুদি দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে তেল কিনে বিক্রি করতে হয়েছিল। তবে গত দুইদিন ধরে বাড়তি টাকা দিয়েও ঢাকার মিরপুর শাহ আলী পাইকারি মার্কেট, কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটসহ বড় পাইকারি বাজারগুলোতে তেল পাওয়া যাচ্ছে না।

বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার পর দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে তেল আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রয় পর্যায়ে কর তুলে নিয়েছে সরকার। রোজার মধ্যে প্রতিলিটার সর্বোচ্চ ১৬০ টাকায় বোতলজাত সয়াবিন তেল এবং খোলা সয়াবিন তেল ১৪০ টাকা এবং পাম তেল ১৩০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। তবে রবিবার বিভিন্ন মুদি দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতি লিটার ২০০ টাকারও বেশি দামে তেল কিনে নিয়ে আসতে হচ্ছে। ফলে তারা বিক্রি করছেন এরচেয়ে বেশি দামে। যদিও ভোজ্যেতল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা দাবি করছেন, তারা আগের মতই সরবরাহ করছেন। মাঝপথে কোথাও ‘গরবড়’ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তারা।

তীর ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল প্রস্তুতকারক সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা দাবি করেন, চাহিদা অনুযায়ী তারা সরবরাহ করছেন। তাদের দিক থেকে কোনো ঝামেলা নেই। তাহলে বাজারে তেল নেই কেন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাজারের বিষয়টা আমরা জানি না।

ঈদের পর দাম বাড়তে পারে- এই কারণে তেল দেওয়া হচ্ছে না এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঈদের পর দর নির্ধারণের বিষয়ে এখনই বলার সুযোগ নেই।

ফ্রেশ ব্র্যান্ডের তেল উৎপাদনকারী মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি অ্যাডভাইজার শফিউর রহমানও একই দাবি করেন। তিনি বলেন, মিল থেকে সয়াবিন ও পাম তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। এরপরও কোথায় কী কারণে তেলের সঙ্কট হচ্ছে সরকারই সেটা খুঁজে বের করবে।

খুচরায় একেবারে উধাও

পীরেরবাগে মুদি দোকানি টিপু সুলতান বলেন, গত দুইদিন ধরে তিনি সয়াবিন তেল কিনতে পারছেন না। ফলে বিক্রি বন্ধ রয়েছে। কিছু রাইস ব্রান তেল রয়েছে তার দোকানে। আরেক দোকানি মহসিন ইসলাম বলেন, তিনি খোলা সয়াবিন তেল প্রতি ড্রাম ৩৭ হাজার ও পাম তেল ৩৫ হাজার টাকা করে কিনে এসেছেন। কিছু পরিচিত ক্রেতাকে এই ঈদের বাজারে স্বস্তি দিতে বেশি দামে কিনে এনেছেন। এতে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের ক্রয়মূল্য ১৮১ টাকা ও পাম তেলের ক্রয় মূল্য ১৭১ টাকা করে পড়েছে।

পাইকারি বিক্রেতারা কোনো পাকা রশিদ দিচ্ছে না। পাকা রসিদ চাইলে তেল বিক্রি করতেও রাজি হচ্ছে না। টাকা নিচ্ছে এক দোকান থেকে তেল দিচ্ছে দূরে আরেক দোকান থেকে। কিছুই বুঝতে পারছি না। বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য স্থানের চিত্রও প্রায়ই একই রকম। প্রায় জায়গাতেই গত দুইদিনে তেল মিলছে না।

চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় এলাকার লাকী স্টোরে তেল নেই শনিবার রাত থেকেই। রবিবার নিয়মিত গ্রাহকদের দিনভরই ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। আগের দিন খাতুনগঞ্জ থেকে বেশি দামে কিনে আনা একটি ব্র্যান্ডের তেল বিক্রি করেছেন প্রতি লিটার পলিব্যাগ ১৬৫ টাকায় এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৮৫০ টাকায়। ১৫ দিন ধরে কোনো কোম্পানির ডিলারের প্রতিনিধি আসে নাই বলে জানালেন দোকানিরা। যোগাযোগ করলে তাদের বলা হচ্ছে, ঈদের পরে দাম বাড়ানো হবে বলে কোম্পানি যেমন তেল ছাড়ছে না, তেমনি কোথাও কোথাও মুজদ করা হচ্ছে।

মোমিন রোডের শরীফ স্টোরে শুধু দুই ব্র্যান্ডের স্বল্প পরিমাণ তেল থাকার কথা জানালেন দোকানি মো. শরীফ। তিনি জানান, বেশি দামে কিনে আনায় পাঁচ লিটারের বোতল ৮৮০ টাকা এবং এক লিটারের পলিব্যাগের সয়াবিন বিক্রি করছেন ১৮০ টাকায়। কোনো কোম্পানির তেলের সরবরাহ পাচ্ছেন না তিনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগেই বেশি দামে তা সংগ্রহ করতে হয়েছে।

কারওয়ান বাজারে রাকিব স্টোর নামের মুদি দোকানের মালিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সরবরাহ সংকটের কারণে তিনি গত দুই দিন ধরে সয়াবিন তেল ও পাম তিল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন সেমাই, চিনিসহ ঈদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্য বিক্রিতে মনোযোগ বাড়িয়েছেন।

পাশের দোকান আলী স্টোরের জসিম উদ্দিন বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে তেল কিনতে না পেরে প্রায় এক মাস ধরে তিনি খোলা সয়াবিন ও পাম তেল বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহও কমে গিয়েছে। দুই একদিন পর ভোজ্যতেলই পাওয়া যাবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

ভোক্তা অধিকারের অভিযান

ভোজ্যতেলের বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গত কয়েকমাস ধরে ‘বিশেষ গুরুত্ব’ দিয়ে কাজ করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। রবিবারও সরকারি এ সংস্থা অভিযান চালিয়েছে কারওয়ান বাজারে। সেসময় একটি দোকানের গুদাম থেকে দুই হাজার লিটার তেল উদ্ধার করেছে।

সংস্থাটির পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, আমরা গত কয়েকদিনে বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন পাইকারি বিক্রেতা ও ডিলারকে অবৈধ মজুদের দায়ে শাস্তি দিয়েছি। কারণ তেলের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কায় তারা পণ্যগুলো মজুদ করে রেখেছেন। কারওয়ান বাজারে বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স নামের একটি পাইকারি দোকান থেকে দুই হাজার লিটার তেলের মজুদ উদ্ধার করেছি। অথচ তারা কয়েকদিন ধরে তেল নেই বলে ক্রেতাদের বার্তা দিচ্ছিল।

এছাড়া মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন পাইকারি দোকানে বিভিন্ন পণ্যের আড়াল থেকে মজুদ তেল উদ্ধারের তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আশঙ্কা করছি ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতারা তেলের মজুদ করছেন। আমরা এর বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নেব। এধরনের দোকানগুলোকে এক মাসের জন্য বন্ধ রাখব।

অথচ পাঁচ দিন আগে কারওয়ান বাজারের বিসমিল্লাহ ট্রেডার্সের আব্দুর রহিম জানিয়েছিলেন, গত সাত দিন ধরেই ভোজ্যতেলের সরবরাহ নাই। সে কারণে আমরাও নিয়মিত গ্রাহকদের কাছে তেল বিক্রি করতে পারছি না। তারা চলে যাচ্ছে অন্য দোকানে।

এর আগে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সময়ে মার্চের প্রথমে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কথা বলে দেশে ভোজ্যতেলের দাম সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অন্তত ৪০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কোথাও কোথাও খোলা সয়াবিনের দাম ২০০ টাকাও নেওয়া হয়। তখনও অনেক এলাকার অনেক দোকানে তেল পাওয়া যায়নি। পরে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি দামও কমে আসে। সেসময় তেল পরিশোধনকারী কারখানাগুলো থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর পরিদর্শন শুরু করে বিভিন্ন অনিয়মও পেয়েছিল ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

মার্চের ওই সময়ে সরকার ভোজ্যতেলের ওপর থেকে ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহারের পর দামেও সমন্বয় করে। নতুন দরে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৪০ টাকা এবং পাম তেল ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

কিউএনবি/বিপুল/ ০২ মে ২০২২ খ্রিস্টাব্দ / বিকাল ৬.২২

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

December 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৬
IT & Technical Supported By:BiswaJit