সিলেট প্রতিনিধি : সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন শাহপরান থানা কমিটির ১ম সম্মেলন গতকাল রবিবার (৯ জানুয়ারি) বিকালে ইসলামপুরস্থ (মেজরটিলা) কার্যালয়ে অনুতি হয়। এর আগে কার্যালয় থেকে জমায়েত হয়ে লাল পতাকা র্যালী তামাবিল সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে ইসলামপুরস্থ সমাবেশস্থলে এসে শেষ হয়। র্যালী পরবর্তী সম্মেলন উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুরুজ আলী। সভায় সভাপতিত্ব করেন শাহপরান থানা কমিটির সংগ্রামী সভাপতি মোঃ দুলাল মিয়া এবং পরিচালনা করেন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক মো. জয়নাল মিয়া।
সম্মেলনের প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক শ্রমিক নেতা রফিকুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সিলেট শহর পূর্বাঞ্চল কমিটির সভাপতি মোঃ খোকন আহমদ, সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি নংঃ চট্ট-১৯৩৩) এর সাধারণ সম্পাদক আনছার আলী। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ স’মিল শ্রমিক ফেডারেশন (রেজি নংঃ বি- ২২০০) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন,জাতীয় ছাত্রদল সিলেট জেলা শাখার অন্যতম নেতা বদরুল আজাদ, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক নাজমুল হোসেন, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহবায়ক মোঃ জালাল মিয়া, সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন জেলা কমিটির অন্যতম নেতা এবং জৈন্তাপুর উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মো. জালাল আহমদ প্রমুখ।
বক্তারা বলেন; অবিলম্বে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গটন করে বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণভাবে মূল মজুরি ২০ হাজার টাকা ঘোষণা ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সম্মত খাবার, মানসম্মত স্টাফ কোয়ার্টারের দাবি জানান এবং হোটেল সেক্টরে শ্রম আইন বাস্তবায়ন ও সিলেট টেক্সটাইল মিলসহ সকল বন্ধ কলকারখানা চালুর জোর দাবি জানান। প্রধান অতিথি তার বক্তব্যে বলেন, আজ এমন এক সময় সিলেট জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন শাহপরান থানা কমিটির ১ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন পৃথিবী এক গভীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক সংকটে জর্জরিত। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস কোটি কোটি মানুষকে আক্রান্ত করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিদিন নভেল করোনা ভাইরাসে মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রচলিত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অসারতা সামনে চলে আসছে। উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলায় দীর্ঘদিনের ঘোষিত লকডাউনে পৃথিবীর সকল দেশের অর্থনৈতিক জীবনসহ সামগ্রিক সামাজিক কর্মকা-কে স্থবির করে দেয়।
সঙ্গত কারণেই নভেল করোনা ভাইরাসজনিত বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় প্রয়োজন ছিল বৈশ্বিক সমন্বিত উদ্যোগ। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও তার বিশ্ব সংস্থা এবং দেশে দেশে দালাল সরকারগুলো তা না করে সংকটের প্রকৃত ঘটনাকে সামনে না এনে নানা রূপের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সংকটের বোঝা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণি, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের উপর চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে দেখা দেওয়া নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রথম দিকে বাংলাদেশে ছিল না। বিদেশ থেকে আগত প্রবাসীদের দেশে ফিরে আসার মধ্যদিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার ঘটে।
বিমানবন্দরে বিমানবন্দরে পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাছাড়া ব্যাপকভাবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ইতালি ও অন্যান্য দেশ থেকে আগত প্রবাসীদেরকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনুষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে না রেখে মফস্বলে গ্রামের বাড়িতে ঘরবন্দী থাকার জন্য বলে দেওয়া হয়। যার মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পথ প্রশস্ত হয়। অথচ সে সময় দেশে আসা প্রবাসীদের যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সরকারি তত্ত্ববধানে কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধ করা সম্ভব হতো। শুরু থেকেই আমাদের দেশের সরকার করোনা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতির কথা জানালেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ছিল না; ‘করোনা থেকে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী’ সরকারের মন্ত্রীদের এমন আস্ফালনমূলক বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
ক্ষমতাসীন সরকার করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাম্রাজ্যবাদ ও তার বিশ্বসংস্থার বৈশ্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনগণকে সচেতন না করে লকডাউনের নামে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, প্রচার মাধ্যমকে স্বপক্ষে ব্যবহারের মাধ্যমে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে জনগণকে দায়ী করে সরকার ও শাসক শ্রেণির দুর্নীতি, লুটপাট, দমন-পীড়ন ও ব্যর্থতাকে ঢাকার অপচেষ্টা চালায়। অতিথিবৃন্দ বলেন, বিদ্যমান শোষণমূলক বিশ্বব্যস্থায় শ্রমিক-কৃষক-জনগণের উপার্জিত অর্থ ও সম্পদ জনগণের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা) পূরণের লক্ষ্যে ব্যয় না হয়ে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতির হাতে কেন্দ্রীভুত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের শোষণ-লুন্ঠন এবং দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি দেশ ও সমাজকে অন্ধকার যুগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনকে, রাজনীতির নামে গোটা দেশ ও সমাজকে কলঙ্কিত করছে। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাজনীতি বিমুখ করার কাজে এরা নিয়োজিত। যুব সমাজের শক্তিকে হীনবল করতে মাদক, অস্ত্রবাজী, নারী নিগ্রহ এ সকল পথ বেছে নিয়েছে।
নারী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন, নারী ও শিশু পাচার, পর্ণোগ্রাফী ও কালোবাজারি, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি গণবিরোধী অসামাজিক কার্যকলাপ বাংলাদেশেও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে আজ ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আজ প্রগতিশীল শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। এই দেশের কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবসমাজ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে জীবন দিয়েছে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের কর্মকান্ডকে বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়নি। নতুন করে বর্তমানেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সকল প্রগতিশীল শক্তিকে সম্মিলিতভাবে হায়েনাদের বিরুদ্ধে, রক্তখেকো ড্রাকুলাদের বিরুদ্ধে, তাদের সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকে রুখে দাঁড়াতেই হবে।
ঐক্যবদ্ধ প্রগতিশীল শক্তি আমাদের দেশে অতীতেও এমন অনেক স্বৈরাচার, স্বৈরাচারের দোসরদের পতন ঘটিয়েছে। বর্তমান দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকদেরকে দাবি আদায়ের আন্দোলনকে অগ্রসর করে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে নিয়ে যেতে হবে এবং শোষণমূলক সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যেই শ্রমিক-কৃষক-জনগণের মুক্তি নিহিত। বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমিক সেক্টর হচ্ছে হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক সেক্টর। গ্রাম্য জোতদার মহাজনের শোষণে জমি-জমা হারিয়ে জীবিকার তাগিদে শহরে এসে হোটেল সেক্টরে অমানুষিক পরিশ্রম করে দুঃখ কষ্টের জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছি। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যে শ্রমিকরা হোটেল রেস্টুরেন্টে সুন্দর ও মজাদার রকমারি খাবার তৈরি ও পরিবেশন করে তাদের পরিবারেই সবদিন দুবেলা ডাল-ভাত জুটে না।
চাল, ডাল, তেল, চিনি, লবনসহ প্রত্যেকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনজীবন আজকে দূর্বিসহ হয়ে পড়ছে। মালিকের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও মালিক আমাদেরকে নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র দেয়নি; নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা ও মানসম্মত কাজের পরিবেশের ব্যবস্থা নেই, এমনকি থাকা খাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই। দেশে চরম বেকারত্বের কারণে যতসামান্য বেতনে আমাদেরক কাজ করতে বাধ্য করা হয়। সরকার গত জাতীয় কমিশনে সরকারি কর্মচারী, মন্ত্রী, এমপিসহ সর্বস্তরের সুবিধাভোগিদের বেতন ভাতা দিগুণ করেছে। কিন্তু হোটেলসহ বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত শ্রমিক ও শ্রমজীবীরা সরকারের এ বেতন কমিশন থেকে বঞ্চিত। দীর্ঘদিন আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে সরকার হোটেল সেক্টরে মজুরি বোর্ড গঠন করে এবং একটি গেজেট প্রকাশ করে।
হোটেল সেক্টরের জন্য যে গেজেট ঘোষণা করা হয়েছ বর্তমান বাজারে তা দিয়ে এক সপ্তাহ চলাই কষ্টসাধ্য। নামমাত্র বেতন নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করলেও মালিকরা তা বাস্তবায়ন করছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরও গেজেট বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। শ্রমিকরা উদ্যোগী হয়ে গেজেট বাস্তবায়নের কথা বললে মালিক ও তার ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা শ্রমিকদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং বিভিন্ন হুমকী দেয়।
কিউএনবি/আয়শা/৯ই জানুয়ারি, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ/রাত ৮:২৯