রবিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:৩৩ পূর্বাহ্ন

মাথায় গুলি লাগার পরও কীভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন মালালা

Reporter Name
  • Update Time : রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
  • ৪৪ Time View

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মাথার এক পাশ ভেদ করে গুলি বের হয়ে মুহূর্তে পুরো শরীরকে নিথর করে দিয়েছিল, চিকিৎসরা বাঁচার কোনো আশাই দেখাননি। তবুও প্রায় অসম্ভব পরিস্থিতিকে জয় করে বেঁচে ফেরেন মালালা ইউসুফজাই। ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর এমনই এক প্রাণঘাতী হামলার শিকার হয়েছিলেন তিনি। কেবল বেঁচে যাওয়াই নয়, পরবর্তীতে তিনি নারী শিক্ষার অধিকার ও সচেতনতার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী প্রতীকী চিহ্ন হয়ে ওঠেন এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান, যা তাকে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেলজয়ীর মর্যাদা এনে দেয়।

ঘটনাটি ঘটে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াত উপত্যকায়। ১৫ বছর বয়সী মালালা তার বন্ধুদের সঙ্গে বাসে চেপে স্কুলে যাচ্ছিলেন, ঠিক তেমনই একটি সাধারণ সকালের মতো। হঠাৎ তালেবানের এক বন্দুকধারী বাসে উঠে মালালার দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুলিটি তার মাথায় প্রবেশ করে এবং কানের পাশ দিয়ে মস্তিষ্কের অত্যন্ত সংবেদনশীল অংশে আঘাত হানতে পারত। আঘাত এতটাই গুরুতর ছিল যে, প্রথম কয়েক ঘণ্টা তার জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েই সন্দেহ ছিল। হামলার সময় মালালার সঙ্গে থাকা দুই বন্ধু কাইনাত রিয়াজ এবং শাজিয়া রমজানও আহত হন।

মালালাকে দ্রুত পেশোয়ারের একটি সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর তার অবস্থা চরম সংকটাপন্ন ছিল। সেনা নিউরোসার্জন কর্নেল জুনায়েদ খান তাকে পরীক্ষা করেন এবং পেয়েছিলেন যে, তার অবস্থা অস্থিতিশীল। চার ঘণ্টার মধ্যেই মস্তিষ্কে ফোলা বেড়ে যাওয়ায় তার জীবন-হুমকি আরও জোরালো হয়। এই মুহূর্তে জরুরি অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

তবে প্রথমে মালালার পরিবার অস্ত্রোপচারে রাজি হননি। তারা জুনায়েদ খানের তুলনামূলক কম বয়স ও অভিজ্ঞতাকে দেখে সন্দেহ করছিলেন। তারা চাননি মালালাকে তখনই অস্ত্রোপচার করা হোক, বরং কোনো বেসামরিক চিকিৎসককে দেখাতে বা দুবাইয়ে স্থানান্তর করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জুনায়েদ খান মালালার বাবা-মাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, অস্ত্রোপচার না করলে মালালার মৃত্যু হতে পারে, অথবা সে কথা বলার ক্ষমতা হারাতে পারে, কিংবা ডান দিকের হাত-পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে।

মধ্যরাতের পর অস্ত্রোপচার শুরু হয়। এই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে খুলির একটি অংশ সরানো হয়, মস্তিষ্কে জমা রক্ত পরিষ্কার করা হয় এবং মালালাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। এতে তার জীবন প্রথমে সুরক্ষিত হয়। তবে পরবর্তী দিনে সংক্রমণ এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যর্থতার কারণে মালালাকে মেডিক্যালি ইন্ডিউসড কোমায় রাখা হয়, তার বেঁচে থাকাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

এই সময় পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে মালালাকে বিদেশে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করেন। যুক্তরাজ্যের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, যা যুদ্ধময় অঞ্চলে আহত সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য বিশ্বখ্যাত। এরপর শুরু হয় মালালার দীর্ঘ চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের অধ্যায়।

চিকিৎসকরা বলেছেন, মালালার বেঁচে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। প্রথমত, গুলি সরাসরি মস্তিষ্কে লাগেনি। দ্বিতীয়ত, দ্রুত চিকিৎসা এবং সময়মতো অস্ত্রোপচার তার জীবন বাঁচাতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তৃতীয়ত, সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং আধুনিক মেডিক্যাল ব্যবস্থার কার্যকর ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। বার্মিংহামে বিশেষ পরীক্ষায় দেখা যায়, মালালার কোনো বড় নিউরোলজিক্যাল ক্ষতি হয়নি।

চিকিৎসার ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া হয়। মুখের পুনর্গঠনমূলক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বুলেট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হাড় ও স্নায়ু মেরামত করা হয়। কানের পর্দার ক্ষতি ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে ঠিক করা হয়, এবং খোলা মাথার খুলির অংশের স্থলে কাস্টম-মেড টাইটানিয়াম প্লেট স্থাপন করা হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মালালা হাঁটতে, লিখতে, পড়তে এবং হাসতেও সক্ষম হন। প্রথমদিকে ট্র্যাকিওটমির কারণে কথা বলতে পারছিলেন না, তবে কাগজে লিখে যোগাযোগ করতেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া দেওয়া হয় এবং পরিবারের সঙ্গে অস্থায়ী বাসায় পুনর্বাসন শুরু হয়।

শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মালালার অদম্য মানসিক শক্তি ও বাঁচার প্রবল ইচ্ছাশক্তি তার দ্রুত সুস্থতায় বড় ভূমিকা রাখে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর দীর্ঘ সময় ধরে ফিজিওথেরাপি এবং কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, আঘাত প্রাণঘাতী হলেও সময়মতো চিকিৎসা এবং মালালার শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে তিনি মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন।

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও মালালা থেমে যাননি। বরং তিনি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। বিশ্বজুড়ে নারী শিক্ষার অধিকার ও সচেতনতার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। পরবর্তীতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান, বিশ্বের অন্যতম কনিষ্ঠ নোবেলজয়ী হিসেবে পরিচিত হন। মালালা নিজেও বলেছেন, তালেবানের হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়া ঘটনা তাকে আরও দৃঢ় ও শক্তিশালী করেছে। মালালার এই অভিজ্ঞতা শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই নয়, মানব জীবনের অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবেও বিবেচিত হয়।

 

 

কিউএনবি/আয়শা/১৪ ডিসেম্বর ২০২৫,/সন্ধ্যা ৬:৫৫

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

December 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৬
IT & Technical Supported By:BiswaJit