ডেস্ক নিউজ : বায়ুদূষণের উৎস ও কারণগুলো চিহ্নিত। এ নিয়ে প্রতি অর্থবছরেই বিশেষ পরিকল্পনা থাকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের। পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সকল মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় আলাদা বরাদ্দও থাকে। প্রকল্পের পর প্রকল্প নিলেও দূষণ নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যত কিছু হয়নি বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। এ জন্য তারা সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পনা আর প্রকল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে বায়ুদূষণ রোধের কাজ।
নবগঠিত টান্সফোর্স এরই মধ্যে প্রথম সভা করেছে। সেই সভায় বায়ুদূষণ রোধে আশু করণীয় পদক্ষেপ নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন, রাস্তার ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে চিহ্নিত সড়কে পানি ছিটানো, ঢাকার বিভিন্ন সড়কে অনাচ্ছাদিত নির্মাণসামগ্রী সারানো ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদান করার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া অনাচ্ছাদিত সড়ক বিভাজন চিহ্নিত করা ও অনাচ্ছাদিত মাটি সবুজে আবৃত করা; বালু, সিমেন্ট ও ইট পরিবহনকারী ট্রাকের পাটাতন ও উপরিভাগে আচ্ছাদন নিশ্চিত করা; ঢাকার সব প্রবেশমুখে ট্রাফিক নজরদারি নিশ্চিত করা; বায়ুদূষণ রোধে শিল্প প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা এবং দূষণরোধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।
টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তের পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু সড়কে পানি ছিটানো হলেও অনেক এলাকায়ই সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এছাড়া পুরনো গাড়ি তুলে নেওয়া, ক্ষতিকর ইটভাটা বন্ধ করার তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান ঘোষণা দিয়েছেন, অক্টোবর থেকে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে যাত্রীবাহী বাস-মিনিবাসের ২০ বছর এবং পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের ২৫ বছর অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে সরকার। অর্থাৎ, যেসব বাস-ট্রাকের বয়স ২০ বছরে থেকে ২৫ বছর হয়ে গেছে, সেগুলো মার্চ মাসের পর থেকে আর চলবে না। এই সময়ের মধ্যে বাস, ট্রাকের মালিকরা নিজ উদ্যোগে তুলে না নিলে সরকারের পক্ষ থেকে জব্দ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
যদিও এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিগত সরকারের আমলেও নেওয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালের মে মাসে যাত্রীবাহী বাস-মিনিবাসের ২০ বছর এবং পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের ২৫ বছর অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে সরকার। তবে ওই বছরের আগস্টে এ প্রজ্ঞাপণ স্থগিত করা হয়। এরপর আবারও পুরনো গাড়ি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সাবেক মন্ত্রী। সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি। এবার হবে বলে আস্থা পাচ্ছেন না পরিবেশবিদরা। বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম প্রসঙ্গে এর পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক আমাদের সময়কে বলেন, শীতের সময় দেশের বাইরে থেকে ৩০-৩৫ শতাংশ দূষণ যোগ হয়। তাই দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এ ছাড়া দূষণের কিছু উৎস্য রয়েছে যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করাটা কঠিন। যেমন যেখানে সেখানে বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে; সেটা কীভাবে কাকে ধরব? অনেকগুলো কাজ হচ্ছে। আশা করি দুয়েক মাসের মধ্যে দৃশ্যমান কিছু দেখা যাবে।
বায়ুদূষণ রোধে ২০১৯ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ছিল ২০২৫ সালের মধ্যে মাটির ইট ব্যবহার পর্যায়ক্রমে পুরোপুরি বন্ধ করা। কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০২৫ সালের পরিবর্তে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, আগে প্রতি বছর ৫০০ থেকে ১ হাজার ইটভাটা বন্ধ করা হতো। বর্তমানে সেই কাজটি আর হচ্ছে না। তবে পোড়ানো ইটের পরিবর্তে ব্লকের ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্থাটি মনে করে এটি সহজেই বাস্তবায়ন করা না গেলেও ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন হবে।
বায়ুদূষণে যেসব উৎস বেশি দায়ী, তারমধ্যে রয়েছে গাড়ির কালো ধোঁয়া, নির্মাণকাজ ও বর্জ্য পোড়ানো, দেশের বাইরে থেকে দূষিত বায়ুর প্রবেশ ও ইটভাটার ধোঁয়া। বিশেষ করে সিটি করপোরেশন এলাকায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে শীতের সময় বেশি দূষণ হয়ে থাকে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য তারা সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছেন।
বায়ুদূষণ সরকারের অগ্রাধিকার ভাবনায় নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, সরকার বায়ুদূষণকে অন্যতম প্রধান সমস্যা মনেই করে না। বর্তমানে বায়ুদূষণ জরুরি অবস্থা জারির করার মতো পরিস্থিতিতে চলে গেছে। এই ক্ষেত্রে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। আগের সরকারও নেয়নি। বর্তমান সরকারেরও তেমন উদ্যোগ দেখিনি। টোটকা পদ্ধতি দিয়ে সমাধান হবে না। বায়ুদূষণ রোধ করতে হলে সরকার এই মূহূর্তে ঘোষণা দিতে পারতÑ আগামী দুই সপ্তাহে ঢাকা শহরে একটি ইটের কাজও চলবে না। এ ছাড়া গাড়ি বন্ধ করার মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। শুধু ছোটোখাটো দুয়েকটা সিদ্ধান্ত নিলে বায়ুদূষণ রোধ করা সম্ভব না।
বাতাসের মানের একটি প্রধান সূচক হলো বাতাসে পিএম ২.৫ এর পরিমাণ। পিএম অর্থ পার্টিকুলেট ম্যাটার এবং ২.৫ অর্থ এর আকার। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, ২০১৮ সাল থেকে, বাতাসে পিএম ২.৫ এর বার্ষিক গড় ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটার ৮৩.২৪ থেকে ১০৪.২০ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে রয়েছে। ছোট আকারের কারণে পিএম ২.৫ মানুষের শ্বাসতন্ত্রের গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং সেখান থেকে পুরো শরীরে ছড়িয়ে স্বল্প থেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে।
বায়ুদূষণে মানসিক সমস্যা দেখা দেয় বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি আমাদের সময়কে বলেছেন, বায়ুদূষণের ফলে শ^াসকষ্ট, অ্যাজমা, হৃদরোগের মতো ঘটনা ঘটে। বন্ধ্যাত্ব বেড়ে যায়। পারিবারিক বিবাদ বেড়ে যায়। সর্বপরি মানুষের জীবনাচার পাল্টে যায়। এ জন্য সরকারের উচিত বায়ুদূষণ রোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
কিউএনবি/আয়শা/২৯ ডিসেম্বর ২০২৪,/দুপুর ২:৩৩