প্রিয় নাহিদ / আমি চিঠি লেখায় ক্ষ্যান্ত দিয়েছি। ইদানিং শুরু করেছি কিছু কিছু বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত লেখালেখি। গুগল, উইকিপিডিয়া, পুরোনো জার্নাল ঘেটে এক একেকটা ট্রপিক্স এর উপর লেখা শুরু করেছি। তুমিতো অনেক ভাল লেখ। আমার লেখাটা পড়ে কেমন লাগে জানাইও।
সংশোধন,পরিমার্জন, পরিবর্ধন কিছু করতে চাইলে, করতে পার। এডিট করে লেখাটা আবার পাঠাবে। ভালো থেকো।
-তোমারই রুমকী।
—————————————–
গোমতী কন্যা মীরা দেব বর্মন
————————————
কুমিল্লায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নদীর নদীর মধ্যে প্রধান নদী গোমতী। ডাকাতিয়া, কাঁকরী, তিতাস নামে আরো ৩টি নদী ও রয়েছে। এর মধ্যে ডাকাতিয়া নতুন ও কাঁকরী প্রাচীন নদী। গোমতীর উৎপত্তি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ী এলাকায়। গোমতীর দৈর্ঘ্য ১৩০.১২২ কিলোমিটার। এটি কুমিল্লার সদর, বুড়িচং, ব্রা্হ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দাউদকান্দি হয়ে মেঘনায় মিলেছে।
গোমতী ও মীরা দেববর্মন বা মীরা দেবী একই প্রবাহের স্রোতস্বীনি এক ধারা যেন। মীরা দেব বর্মনের নিজের লেখা গান যখন থেকে শুনি এবং যখন থেকেই তাঁর জন্ম ইতিহাস জানি, তখন থেকেই মীরা দেব বর্মনকে আমি ”গোমতী কন্যা” হিসাবে ডাকি, স্মরণ করি, শ্রদ্ধার অর্ঘ্য অর্পণ করি অন্তরের অন্তস্থল থেকে।
মীরা দেব বর্মনের জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লায় ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে। ছোটবেলা থেকে দাদু ও দিদিমার বাড়ীতে থাকতেন। তার দাদু রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন ঢাকা হাইকোর্ট-এর চিফ জাস্টিস। পড়াশুনো সঙ্গে সঙ্গে তিনি সঙ্গীত শিক্ষা নিতেন। সঙ্গীত গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। কীর্তন ও ঠুমরী শেখেন সঙ্গীতাচার্য ধীরেন্দ্রনাথ দেবের কাছে। ১৯৩০ সালে আনাদি দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্র সঙ্গীতের শিক্ষা লাভ করেন। তিনি নাচ শিখেন শান্তিনিকেতনে আমিতা সেনের কাছে।
মীরা দেববর্মন হলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন খ্যাতনামা গীতিকার এবং সঙ্গীত শিল্পী। তিনি ভারতের প্রখ্যাত সুরকার শচীন দেব বর্মনের স্ত্রী এবং রাহুল দেব বর্মনের মাতা এবং আশা ভোঁশলের শাশুড়ী। কথিত আছে, সঙ্গীতগুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের তালিম নেওয়ার সময় পরিচয় হয় ভীষ্মদেবের আর এক কৃতী ছাত্র শচীন দেববর্মনের সঙ্গে। গুরুর থেকে বয়সে বছর ২-৩ ছোটো ছিলেন শচীন। শোনা যায় যে মীরা দেবী ও শচীনের প্রেম ভীষ্মদেব খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি এবং তার ঠিক পরেই আরো দু’একটা ঘটনা নিয়ে শচীন কর্তা ও ভীষ্মদেবের সম্পর্কের মধ্যে একটা শীতলতা এসে পড়ে। ভীষ্মদেব সব ছেড়েছুড়ে পন্ডিচেরী চলে যান।
মতান্তরে, ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে এলাহাবাদ নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মেলনে শচীন দেববর্মনের সাথে তার পরিচয় হয়। সেই বছরই তিনি শচীন দেববর্মনের শিষ্যত গ্রহণ করেন এবং একই বছরে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর শচীন দেব বর্মন মীরা দেববর্মনের লেখা কয়েকটি গানে সুর প্রদান করেন।
বিবাহের বছরে অল ইন্ডিয়া রেডিও, কলকাতা থেকে অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হন। শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে বম্বে গিয়ে মীরা দেবী ফয়াজ মহম্মদ খানের কাছে আবার তালিম নিতে শুরু করলেন। ১৯৪৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও, বোম্বে থেকে অডিশন পাশ করে ঠুংরি ও গজল পরিবেশন করতেন। সেই সময় তিনি দুইটি নাটক শান্তি ও নয়া প্রভাতের গানের কথা রচনা করেন। শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে অনেক গানের রেকর্ডও করেন তিনি। উল্লেখযোগ্য গান গুলো হলোঃ –আজ দোল দিল কে~(১৯৪৬),তুম হ বড়ে চিতচোর ~(১৯৪৬),কেন হায় স্বপ্ন ভাঙ্গার আগে~(১৯৪৯),কালি বদরিয়া ছা গয়ে, ডালি ডালি ফুল~(১৯৪৮),কে দিল ঘুম ভাঙ্গায়ে~(১৯৪৯)।
সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবেও তিনি ছিলেন একজন সফল মানুষ। নয়া জমাণা, তেরে মেরে স্বপ্নে, শর্মিলি, অভিমান, বারুদ, প্রেম নগর – এই বিখ্যাত চলচ্চিত্র গুলোর সহযোগী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রে বাইরে মীরা দেববর্মনের গাওয়া ও লেখা অনেকগুলো গান জনপ্রিয় হয়। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলোঃ
*কে যাস্ রে ভাটি গাঙ বাইয়া
*তাক্ দুম তাক্ দুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল
*না আমারে শশী চেয়ো না
*বর্ণে, গন্ধে, ছন্দে, গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা
*বিরহ বড় ভালো লাগে
*রাতের আতরে ভিজাইয়া আদরে
*শোনো গো দখিন হাওয়া, প্রেম করেছি আমি
*ও বাঁশি ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা পান খাইয়া যাও
*নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক, পায়েলখানি বাজে
*সুবল রে বল বল
এই গান গুলোর মধ্যে গোমতী কন্যা মীরা দেব বর্মন এর লেখা গান ”বর্ণে, গন্ধে, ছন্দে, গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা” তাঁর স্বামী শচীন দেব বর্মনের কণ্ঠে এক সময় পাগলের মত শুনতাম। এখনো শুনি। আজও শুনছি —-
বর্ণে,গন্ধে, ছন্দে,গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছো দোলা
রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে, একি তব হরি খেলা?
তুমি যে ফাগুন, রঙের আগুন, তুমি যে রসের ধারা
তোমার মাধুরী, তোমার মদিরা করে মোরে দিশাহারা
মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে, তেমনি আমাতে তুমি
আমার পরাণে প্রেমের বিন্দু তুমি, শুধু তুমি—-
লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।
কিউএনবি/নাহিদা/১৫.০৮.২০২৩/রাত ৯.৩৫