সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪৮ অপরাহ্ন

নাহিদ-রুমকী পর্ব-৬১, রুমকীর কথা

Reporter Name
  • Update Time : বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২
  • ৬৫৫ Time View

 রুমকীর কথা
—————–
১৯৯০ সালের মধ্য অক্টোবরে সমগ্র বাংলাদেশে বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস শেষ করেনি নাহিদ। কিন্তু থামিয়ে দেয়া হল নাহিদকে। রুমকী নাহিদের হাতটা চেপে ধরে বলল, এবারে তুমি একটু থামো। আমি কিছু বলতে চাই। মুহিদ,কমল, নিপা সায় দিল রুমকীকে। ঠিক আছে তুমি বলো রুমকী। দেখি তুমি আবার কোন আগুন ঝরা দিনগুলোতে আমাদেরকে নিয়ে যেতে পার ?

রুমকী শুরু করল, মধ্য অক্টোবর থেকে বাতাসে বারুদের গন্ধ পাচ্ছি। নিরব নিস্তব্ধ ক্যাম্পাসে ঝিরঝির বাতাসে ইউক্যালিপ্টাস গাছ গুলোর পাতা যেন ফিসফিসিয়ে শহীদ জেহাদের কথা বলে, শহীদ মনিরুজ্জামানের আহাজারির শব্দ ছড়ায়। এরশাদ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু লাইব্রেরি খোলা থাকে। মিরপুর থেকে চৈতালি বাস সংখ্যায় কম হলেও ক্যাম্পাসে নিয়মিত যাতায়ত করে। লাইব্রেরি ওয়ার্কের জন্যে এই সার্ভিস সংক্ষিপ্তাকারে চালু রাখা হয়েছে।

আমি প্রতিদিন ক্যাম্পাসে আসি। মিরপুরের ইব্রাহিমপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অনেক দূরে। তারপরেও আমি নিয়মিত ক্যাম্পাসে আসি। আমার নিয়মিত লাইব্রেরি ওয়ার্ক করার প্রয়োজন হয়না। তারপরেও আমি নিয়মিত ক্যাম্পাসে আসি। আমি ক্যাম্পাসে আসি শুধু তোমার জন্যে নাহিদ। শুধু এক পলকের জন্যে তোমাকে দেখতে পাওয়ার আগ্রহে আমি প্রতিদিন ক্যাম্পাসে আসি। কিন্তু তোমার দেখা আমি পাইনা।

রুমকীর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আসছে। ভেজা ভেজা কণ্ঠে রুমকী বলে যাচ্ছে, ক্যাম্পাসের যে সমস্ত জায়গা গুলোতে আমি আর নাহিদ ঘুরে বেড়াতাম, সে জায়গা গুলোতে আমি ঢুঁ মারি। টিএসসি, হাকিম চত্বর, লাইব্রেরির সম্মুখভাগ, মধুর কেন্টিন, লেকচার থিয়েটার, ক্যাম্পাস শ্যাডো, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ, কোথায় না খুঁজেছি তোমাকে আমি নাহিদ? কিন্তু নাহিদ তুমি লাপাত্তা।

সকালে চৈতালির প্রথম বাসে আসতাম। দুপুরে রোকেয়া হলের ডাইনিংয়ে ৬ টাকা দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিতাম। ঘুঘু ডাকা অলস দুপুরে আমি নাহিদকে খুঁজতে বের হতাম। নাহিদের সংগে আমার জরুরি কোন কথা নেই, কোন কাজ নেই, তারপরেও আমি তাকে খুঁজতাম। ওকে এক নজর দেখার জন্যে সব সময় আমি ছটফট করতাম।

নাহিদকে খুঁজতে খুঁজতে আমি যখন ক্লান্ত হই, তখন লাইব্রেরির বারান্দায় বসে নাহিদের কথা ভাবি। নাহিদের উপর আমার বেজায় রাগ। ,অনেক রাগ হয় ওর কান্ডকীর্তির জন্যে। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল জটিলতায় যে দ্বন্দ শুরু হল, সে দ্বন্দে গভীরভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে নাহিদ। আমি নিজ চোখে দেখেছি, ডাকসু ভবনের সামনে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আমানুল্লাহ আমানের বক্তব্য বাধা দিতে গিয়ে নাহিদ তাঁর মুখ চিপে ধরেছে। এ দৃশ্য দেখে তাৎক্ষণিক ভাবে নাহিদের প্রতি আমার ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছিল।

একটু দম নিয়ে রুমকী আবার শুরু করল। ১০ই অক্টোবরে জেহাদ শহীদ হলো। জেহাদের লাশ অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে স্ট্রেচারে শোয়ানো। শেখ হাসিনা এসেছেন লাশ দেখতে। লাশ দেখার পর শেখ হাসিনা সকলের উদ্যেশ্যে বক্তব্য দেয়া শেষ করে যখন ”জয় বাংলা” বললেন, তখন উত্তেজিত অনেকের মধ্যে নাহিদের আচরণ আমাকে হতবাক করেছিল। শেখ হাসিনার সম্মুখে মাইকের স্ট্যান্ডটি নাহিদ কেড়ে নিয়েছিল। অপরাজেয় বাংলার অদূরে দাঁড়িয়ে আমাকে এমন কুৎসিত দৃশ্য দেখতে হয়েছে।

মুহিদ ভাই, কমল ভাই, নিপা ভাবী, আমি এক মফস্বল শহরের মেয়ে। আমার দুচোখ ভরা স্বপ্ন ছিল। স্কুল ও কলেজ জীবনে মেধাবী ছাত্রী ছিলাম আমি। স্বপ্ন দেখতাম অনেক বড় হব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক চান্সেই ভর্তি হয়ে গেলাম। নাহিদের সংগে আমার পরিচয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেয়ে। তার আগে নাহিদ আমাকে দূর থেকে অনেক দেখেছে, কিন্তু আমি তাকে দেখলাম জীবনের প্রথম কাজলা, মতিহার চত্বরেই। আমাদের দুজনের কথা হয় রাজশাহী থেকে ফিরতি বাসেই।

আমি যখন নিতান্তই শিশু, আমার মায়ের সঙ্গে বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তখন। ডিভোর্স হয়নি। কিন্তু পার্মান্যান্টলি দুজনের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। মা একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। তাঁর বেতনেই পিঠাপিঠি আমাদের চার ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ চলে। বলতে গেলে আমার জীবনটা বড় কষ্টের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসতে আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।

নাহিদ কখনও আমাকে বলেনি, আমি তোমাকে ভালোবাসি অথবা আমি কখনও নাহিদকে ভালোবাসার কথা বলিনি। কিন্তু অনেক দেরিতে হলেও বুঝতে পারলাম নাহিদকে আমি ভালোবাসি। ছাত্রদলের মিছিল যখন মধুর ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে আসত, আমি কলাভবনের নিচ তলায় আমাদের ডিপার্টমেন্টের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিছিলের মাঝে নাহিদের মুখ খুজতাম। সাদা রেবক কেডস, হারা জিন্সপ্যান্ট, ক্রোকোডাইলস টি শার্ট পরিহিত নাহিদের চোখে রিবন গ্লাসে অদ্ভুত সুন্দর দেখাতো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকতাম নাহিদের দিকে। নাহিদ থাকতো একদম মিছিলের শেষে।

হটাৎ একদিন খেয়াল করলাম মিছিলের শেষের দিকে নাহিদ সহ কেউ শার্ট বা টিশার্ট ইন করতনা। এর কারণ কি ? একদিন নাহিদকে কলাভবনের আমতলায় ডেকে এনে ঘনিষ্ট ভাবে বসে কৌশলে ওর কোমর স্পর্শ করে ধাতব কিছুর স্পর্শ পেলাম। নাহিদকে জোরাজুরি করতেই সে স্বীকার করল, তার কোমরে থাকে পয়েন্ট ৩২ ক্যালিবারের পিস্তল। এই জন্যে সে বা মিছিলের পিছনে অবস্থানরতরা কেউ ইন করত না। ওদের কোমরে বাস করে আগ্নেয়াস্ত্র।

রুমকী সকলকে চমকে দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। আমি এমন একজনকে ভালোবেসেছি যে আমার মত সংস্কৃতি ধারণ করেনা। আমি দুই বাংলার প্রেমের কবিতা পড়ি, সুনীলের মোটামোটা বই পড়ি, নজরুল গীতি শুনি। আর সেই আমি কিনা এমন একজনকে ভালোবাসি, যার কোমরে বাস করে মানুষ হত্যার জন্যে ব্যাবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র।

 

লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।

 

 

 

 

কিউএনবি/বিপুল/২৮.০৯.২০২২/ রাত ১০.২২

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

October 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit