মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৮ পূর্বাহ্ন

জীবনের জলসা ঘরে : একজন মায়াবতী সোমা জামান এর কথা

Reporter Name
  • Update Time : রবিবার, ১৩ মার্চ, ২০২২
  • ১৬৭ Time View

 

ফেসবুকে আমি নিয়মিত পোস্ট দেই। জীবনের খন্ডচিত্র আঁকার চেষ্টা করি। কখনো কখনো সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রসঙ্গে লিখি। কখনো কখনো সেই কথাগুলো নিউয়র্কের কুইন্সের অবরোধ বাসিনী রুমকীর মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে, আবার কখনো ঢাকায় নাহিদের কণ্ঠ থেকে বের হয় সেই সব বিক্ষুব্ধতার কথা।

মাস দুয়েক আগে নিউয়র্কের ম্যানহাটান থেকে এক ভদ্রমহিলা ফেসবুকে এড হলেন। প্রাথমিক পরিচয়ে কিছু কিছু কথা হয়েছে। কি করেন, কোথায় থাকা হয়, পারস্পরিক বিষয়গুলো প্রসঙ্গক্রমে জানা হয়ে গিয়েছিল। ভদ্রমহিলা ম্যানহাটান এ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট এর মালিক। তার রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশের কমিউনিটি হলের মত বিয়ে, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী অথবা যেকোন সভা সমিতির অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। স্বভাবতই ভদ্রমহিলা খুব ব্যস্ত। ভদ্র মহিলার নাম সোমা জামান।

একদিন সোমা জামান ফোন দিলেন। প্রসঙ্গটা রাজনীতি নিয়ে। তিনি বিএনপির সমর্থক। বেগম খালেদা জিয়া তার আদর্শিক চরিত্র একজন। খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় তিনি সুদূর আমেরিকা থেকে রোজা রেখেছেন, কোরান তেলোয়াত করেছেন, বিশেষভাবে দোয়া করেছেন। সোমা জামান সক্রিয় রাজনীতি করেন না। বিএনপির বৈদেশিক সাংগঠনিক কার্যক্রমে তিনি যুক্ত নন। দলীয় পদ তাকে আকর্ষণ করেনা। তিনি অন্তর দিয়ে বিএনপিকে ভালোবাসেন।

টুকরো টুকরো কথায় অনেক কথা বের হয়ে আসে। কথার পিছনের কথা। কয়েক বছর আগে সোমা জামানের স্বামী একসিডেন্টে মারা গেছেন। কোলে তখন তার একমাত্র ছেলে, নিতান্তই শিশু সন্তান। স্বামীর রেখে যাওয়া ছোট্ট পরিসরের রেস্টুরেন্ট ব্যবসার হাল ধরেন তিনি। আস্তে আস্তে তার চেইন রেস্টুরেন্ট বিশাল আকার ধারণ করে। করোনা পরিস্থিতি শুরুর আগে আগেই ব্যাংক থেকে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ২৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েন। করোনার কারণে দীর্ঘদিন তার সকল রেস্টুরেন্ট বন্ধ ছিল।

এরপরে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে ব্যাংক থেকে সোমা জামান আপৎকালীন এই সময়টুকুর সুদ মওকুফ করে নেন। দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে থাকেন। আর মাত্র দু মাসের মধ্যে তিনি ব্যাংকের ঋণ থেকে মুক্তিলাভ করবেন। সব কথা শুনে আমি স্বস্তি প্রকাশ করি। আমার চোখের সামনে ভাসে একজন সংগ্রামী মহিলার ছবি। প্রবাসে একজন বাংলাদেশী মহিলার সফল বিজনেস এন্টারপ্রেনারশিপ আমাকে মুগ্ধ করে।

হটাৎ করে দেখি সোমা জামান যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। কোন সাড়া নেইতো নেই। এভাবে কেটে যায় প্রায় পনেরো দিন। তারপরে আবার হুশ করে উদয় হয়ে জানালেন, আমার শশুর খুব অসুস্থ ছিল। হাসপাতাল, ডাক্তার, ঔষুধের দোকান এই নিয়ে তার সময় পার করতে হয়েছে। সঙ্গত কারণেই তিনি আর যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি।

খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়ে সোমা জামান মুষড়ে পড়েননি। অথবা নতুন ভাবে সংসার জীবন শুরু করে একমাত্র ছেলের চোখে সারাজীবনের জন্যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরী করেননি। সোমা জামান তার ব্যবসা কর্মের মাঝেও সোশ্যাল ওয়ার্ক করে যাচ্ছেন। আমেরিকায় বাংলাদেশী বেকার ছাত্র-ছাত্রী অথবা বৈধ ওয়ার্ক পারমিটের অভাবে যে সকল বাংলাদেশী মানবেতর জীবন যাপন করছেন, পরম মমতায় ঝুঁকি নিয়েও তাদের কাজ দিচ্ছেন, তাদের বাঁচার অবলম্বন সৃষ্টি করছেন।

সবচেয়ে মুগ্ধ করল, খুলনায় তার পিত্রালয়ের কাছে একটি এতিমখানা করেছেন। ২৮৬ জন এতিম ছেলে মেয়ে ইসলামী শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছে। সুদূর নিউয়র্কের ম্যানহাটান থেকে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখেন এতিমখানার। একটা এতিম শিশু অসুস্থ হলে সরাসরি ভিডিও কলে সাহস দেন সোমা জামান, আর তিনি কাটান বিনীদ্র রজনী।

একজন মায়াবতী সোমা জামানের একান্ত জীবন বিষাদে ভরা। মাঝে মাঝে শূন্যতা গ্রাস করে তাকে। তখন তিনি গান শোনেন, গেয়েও থাকেন। অধুনা টিকটকে গান তুলে ফেসবুকে ছেড়ে মজা কুড়ান। কিন্তু তারপরেও তার জীবন শূন্য। এক ঝটকা লিলুয়া বাতাস তাকে উদাসীনতার জগতে নিয়ে যায়। কখনো কখনো বিশাল সমুদ্র তীরে বসে ফিরে তাকান সোমা জামান তার অতীতে। চোখের সামনে সমুদ্রের এত নোনা জল থাকতেও তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে আরো কিছু নোনা জল।

পাদটীকাঃ লেখাটা ভদ্রমহিলার অনুমতি নিয়েই লিখেছি। প্রথমে নাম উল্লেখ করিনি। পরে তিনি নিজেই জানালেন নাম দিতে পারেন। আমার লেখাপড়ে সোমা জামান ফোন কলে কেঁদেই যাচ্ছেন। আমার লেখা পড়ে কেউ কাঁদুক তা চাইনা। তারপরেও মানুষের বুকে এত কান্না কোথায় লুকিয়ে থাকে? সমুদ্রের দিকে তাঁকিয়ে ছবিটি সোমা জামানের। একজন মায়াবতীর।

লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।

কিউএনবি/বিপুল/১৩ই মার্চ, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ | সকাল ১১:৫১

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আর্কাইভস

September 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৫-২০২৩
IT & Technical Supported By:BiswaJit