আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতে নির্বাসিত তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা জানিয়েছেন, তার অবর্তমানে যাকে উত্তরসূরি বেছে নেওয়া হবে তিনি তাদের কয়েক শতাব্দী প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যকে বজায় রাখবেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে তার ‘গাহদেন ফোড্রাং ট্রাস্ট’। এই প্রসঙ্গে অন্য কারো ‘হস্তক্ষেপ’ চলবে না।
অতীতে উত্তরসূরির বিষয়ে তাকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত দেখা গিয়েছিল। তবে বুধবার এই বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের প্রধান পেনপা সেরিং জানিয়েছেন দালাই লামার সিদ্ধান্তকে তারা সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন করছেন। পাশাপাশি জানিয়েছেন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিব্বতীরা দালাই লামাকে ‘তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের’ প্রাতিষ্ঠানিক পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সেই অনুরোধে সম্মতি জানিয়েছেন দালাই লামা।
এর আগে ৬০০ বছরের পুরানো ঐতিহ্য ভবিষ্যতেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে কি না সে বিষয়ে দ্বিধায় ভুগতে দেখা গিয়েছিল দালাই লামাকে। তবে দালাই লামা বাছাই করার যে ঐতিহ্য সেটা তারা ভবিষ্যতেও বজায় রাখতে চলেছেন, এই বিষয়টি বুধবার স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
একটি ভিডিও বার্তায় দালাই লামা জানিয়েছেন, তার অবর্তমানে পরবর্তী দালাই লামাকে বেছে নেওয়া হবে। তার পুনর্জন্মকে খোঁজা এবং শনাক্ত করার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণরূপে ‘গাহদেন ফোড্রাং ফাউন্ডেশন’-এর অধীনে হবে এবং ‘এই বিষয়ে অন্য কারও হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।’
সংবাদ সম্মেলনে দালাই লামার জ্যেষ্ঠ সহযোগী সামধং রিংপোচের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা তার উত্তরসূরি কে হবেন সে সম্পর্কে অন্য কোনো বার্তা দেবেন কি না।
উত্তরে সামধং রিংপোচ বলেন, এই বিষয়ে তখনই জানানো হবে ‘যখন সময় আসবে।’ এই বিষয়ে দালাই লামার কাছ থেকে ‘আর কোনো প্রকাশ্য বার্তা আসবে না’ বলেও জানিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে, পেনপা সেরিং জানিয়েছেন, দালাই লামার জন্মদিন উদযাপনের আগে যে ১৫তম তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেখানে অংশগ্রহণকারী সকলেই দলাই লামার উত্তরাধিকার সম্পর্কে ঘোষণাকে সমর্থন করেছেন।
চীনের প্রতিক্রিয়া
দালাই লামার ঘোষণার পর বেইজিং তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা ওই সিদ্ধান্তকে মানতে নারাজ।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বেইজিং দালাই লামার বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তার উত্তরসূরি বাছাইয়ের বিষয়ে ‘চীন সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন’।
জানানো হয়েছে, দালাই লামার উত্তরসূরিকে অবশ্যই চীনা আইন ও বিধিবিধানের পাশাপাশি তাদের ‘ধর্মীয় আচার ও ঐতিহাসিক রীতিনীতি’ মেনে চলতে হবে।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরও বলেন, দলাই লামার উত্তরসূরিকে শনাক্ত করা ‘লট-ড্রয়িং’ সিস্টেমের মাধ্যমেই সম্ভব। যেখানে একটি সোনার কলস থেকে নাম বেছে নেওয়া হয়।
এই প্রথা ১৭৯২ সালে চালু করা হয়েছিল এবং বর্তমান দালাই লামার কয়েকজন পূর্বসূরিদের বেছে নিতে এই পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমান দালাই লামার ক্ষেত্রে তা হয়নি।
সমালোচকদের মতে ওই প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করে চীনা কর্তৃপক্ষ। যদিও এই অভিযোগ চীন অস্বীকার করে।
এদিকে বেইজিংয়ের দাবি, এই প্রথা তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের একটি ‘অনন্য রূপ’ এবং চীন সরকারের ‘ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা’ অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
দালাই লামাকে ‘অনুরোধ’
এদিকে, দালাই লামা যে সকলের অনুরোধেই তার পরবর্তী উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা জানিয়েছেন পেনপা সেরিং।
তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিব্বতীরা ‘একনিষ্ঠ ভক্তির সঙ্গে আন্তরিক অনুরোধ’ জানিয়ে দালাই লামাকে বলেছিলেন, ‘চেতনাযুক্ত সমস্ত প্রাণী এবং বিশেষত বৌদ্ধদের হিতার্থে’ তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের শীর্ষ আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে দালাই লামার পদ ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকা উচিত।
তিনি জানিয়েছেন, বিপুল সংখ্যক মানুষের আর্জিতে শেষপর্যন্ত সম্মতি জানিয়েছেন দালাই লামা।
পেনপা সেরিং আরও জানিয়েছেন, দালাই লামার পুনর্জন্মকে স্বীকৃতি দেওয়ার মূল প্রক্রিয়াটি তিব্বতীয় বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে।
তিব্বতীয় বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন, প্রবীণ সন্ন্যাসীদের দেহত্যাগের পর তাদের পুনর্জন্ম হয়।
একজন দালাই লামাকে তখনই বেছে নেওয়া হয় যদি কর্মকর্তারা এই বিষয়ে নিশ্চিত হন যে যাকে তারা বেছে নিচ্ছেন, তিনিই তার পূর্বসূরির পুনর্জন্ম।
বর্তমান দালাই লামার বয়স যখন মাত্র দুই বছর, তখনই তিনি তার পূর্বসূরীর পুনর্জন্ম হিসেবে চিহ্নিত হন।
৯০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠান ও উত্তরসূরির প্রসঙ্গ
দালাই লামার ৯০তম জন্মদিন রোববার পালন হওয়ার আগে বুধবার সকাল থেকে তিন দিনব্যাপী ধর্মীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটি ১৫তম তিব্বতি ধর্মীয় সম্মেলন। তিব্বতি চান্দ্র ক্যালেন্ডার অনুসারে দালাই লামার জন্মদিন উদযাপন শুরু হয়েছে সোমবার থেকে।
এই অনুষ্ঠানে ভারতের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীসহ সাত হাজারেরও বেশি অতিথি উপস্থিত থাকার কথা।
সোমবার প্রকাশ্যে আসা অতিথিদের সমাগমের ছবির মধ্যে হলিউড অভিনেতা রিচার্ড গেরেও রয়েছেন। প্রকাশ্যে আসা ছবিতে দেখা যায় তার দীর্ঘদিনের অনুসারী রিচার্ড গেরেকে আশীর্বাদ করছেন দালাই লামা।
এর আগে, দালাই লামা জানিয়েছিলেন তার ৯০তম জন্মদিনের কাছাকাছি সময়ে এসে উত্তরাধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত প্রকাশ করবেন। তাই, তিনি যে তার উত্তরসূরির বিষয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিতে পারেন সেই বিষয় নিয়ে ব্যাপক প্রত্যাশা জন্মেছিল।
এদিকে সোমবারের সমাবেশে তাকে বলতে শোনা যায় ‘একটি ফ্রেম ওয়ার্কের মধ্যে থেকে আমরা দালাই লামাদের প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে কথা বলতে পারি।’
তবে এই বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।
উত্তরসূরি নির্বাচনে ‘দ্বিধা’
উত্তরসূরির বিষয়ে অতীতে দ্বিধায় ভুগতে দেখা গিয়েছিল নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এই তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের আধ্যাত্মিক নেতাকে।
কয়েক বছর আগে তিনি বলেছিলেন, তার উত্তরসূরি একজন মেয়ে হতে পারেন বা আদৌ তার কোনো উত্তরসূরি নাও থাকতে পারে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, অবশ্য তিনি জানিয়েছিলেন যদি ওই বিষয়ে নির্বাসিত তিব্বতীদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন থাকে তবে এই ঐতিহ্য ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে এবং উত্তরসূরি বেছে নেবে তার কার্যালয়।
চীনের বিরোধিতা
১৯৫৯ সালে তিব্বতে চীনা শাসনের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান দালাই লামা।
তিনি উত্তর ভারতের পার্বত্য শহর ধর্মশালায় একটি নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এরা সেই ব্যক্তিদের কাছে বিকল্প ক্ষমতার উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেন যারা তিব্বতে বেইজিংয়ের কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেন।
অন্যদিকে, চীনের দাবি- পরবর্তী দালাই লামা কে হবেন, তা বেছে নেওয়ার অধিকার তাদের।
দালাই লামা বলে আসছেন, তার উত্তরসূরি চীনের বাইরে জন্মগ্রহণ করবেন, যা বেইজিংকে ক্ষুব্ধ করেছে।
মার্চ মাসে প্রকাশিত তার বই ‘ভয়েস ফর দ্য ভয়েসলেস’-এও একই বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
যদিও দালাই লামা তিব্বতের বিষয়ে একটি ‘মধ্যম পন্থার’ কথা বলে এসেছেন। তিনি চীনের মধ্যে থেকেই প্রকৃত স্ব-শাসনের পক্ষে ছিলেন যা বেইজিং মেনে নেয়নি এবং তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে বিবেচনা করে।
তবে দালাই লামার বুধবারের ঘোষণা চীনের জন্য পরোক্ষভাবে এক জাতীয় বার্তা বলেই মনে করা হচ্ছে। যেখানে এই বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে পরবর্তী দালাই লামা কে হবেন, সে বিষয়ে অন্য কারো ‘হস্তক্ষেপ’ বরদাশত করা হবে না।
লন্ডনে অবস্থিত ‘স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’-এর তিব্বত বিষয়ক গবেষক রবার্ট বার্নেট দালাই লামার বক্তব্যের তাৎপর্য নিয়ে বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন।
তার কথায়, ‘তিনি (দালাই লামা) এখানে দু’টি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। প্রথমটি হলো তার (দালাই লামার) উত্তরসূরি কে সে বিষয়ে চীন নয়, বরং সিদ্ধান্ত নেবে তার প্রতিষ্ঠা।’
‘অন্যটি হচ্ছে, তিনি চীনকে দেখাতে চেয়েছেন এই সিদ্ধান্ত এক ধরনের জনপ্রিয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে– যাকে আমরা প্রায় গণতান্ত্রিক (পদ্ধতি) বলতে পারি। কমিউনিটির কাছে জানতে চাওয়ার প্রক্রিয়া যে এই প্রতিষ্ঠান চালান হোক তা তারা চান কি না।’
বার্নেট জানিয়েছেন, এটি চীনের জন্য একটি সংকেত। কারণ দেখানো হয়েছে যে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের বৈধতা সকলের সম্মতির ওপর ভিত্তি করে এনেছে, বলপ্রয়োগের ওপর নয়।
কিউএনবি/আয়শা//০২ জুলাই ২০২৫,/বিকাল ৫:৪৩